আরিফ উদ্দিন- গাইবান্ধা প্রতিনিধি,সম্পাদনায়-আরজে সাইমুর: গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যার মুল পরিকল্পনাকারি ও অর্থ যোগানদাতা সুন্দরগঞ্জের জাপা (এ) সাবেক এমপি কর্ণেল (অবঃ) ডাঃ আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় বগুড়া শহরের রহমান নগর জিলাদারপাড়া তার বাসা থেকে গ্রেফতার করে রাতে গাইবান্ধায় নিয়ে আসা হয়।
এছাড়া মঙ্গলবার সকালে গাইবান্ধা শহরের ব্রীজ রোড এলাকা থেকে তিন খুনি কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর সমস কবিরাজ পাড়া গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২), উত্তর সমস বেকাটারি গ্রামের ওসমান গণির ছেলে শাহীন (২৩) এবং কাদের খানের গাড়ি চালক বগুড়ার শাহজাহানপুর থানার কামারপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে হান্নান (২৭) কে গ্রেফতার করা হয়। অপর খুনি রানাকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে সক্ষম না হলেও শীঘ্রই সে ধরা পড়বে বলে উল্লেখ করা হয়।
এ ব্যাপারে বুধবার সকালে গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কার্যালয় চত্বরে প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এসময় রংপুর রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি বশির আহমেদ, গাইবান্ধা পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম, এডিশনাল এসপি (এ সার্কেল) রবিউল ইসলাম, এডিশনাল এসপি (হেড কোয়ার্টার) খায়রুল আলম, সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান, গাইবান্ধা থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম মেহেদী হাসান ও মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আবু হায়দার মোঃ আশরাফুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রেস ব্রিফিংয়ে এমপি লিটন হত্যা মামলার বাদি তার বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী, লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি এবং পরিবারের অন্যান্য লোকজন, গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র অ্যাড. শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনসহ জেলা আওয়ামী লীগ, অন্যান্য দল নেতৃবৃন্দ ও জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়ঃ
প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি জানান, পুলিশ ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে এক মাস ২০ দিনের তদন্ত শেষে ২১ ফেব্র“য়ারি মঙ্গলবার চাঞ্চল্যকর এই লিটন হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। এমপি লিটনকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় ওই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার মোহেই সাবেক এমপি কাদের খান এক বছর আগে থেকেই এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনা করে। এজন্য তিনি তার ঘনিষ্ঠ ৪ সহচর মেহেদী হাসান, শাহীন, হান্নান ও রানাকে প্রলুব্ধ করে এবং নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাদের ৬ মাসব্যাপী নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। তার ছক অনুযায়ি ইতোপূর্বে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আসার পথে এমপি লিটনকে গত অক্টোবর মাসে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা ব্যর্থ হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ি রাস্তায় প্রথমে তার গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এতে গাড়ি থামিয়ে লিটন বের হয়ে আসা মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে ওই কিলাররা। কিন্তু সে মিশনও ব্যর্থ হয়।
লিটন হত্যা মিশনঃ
সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হয়। লিটন হত্যা মিশনে ৩ জন হত্যাকারি অংশ নেয়। তারা হলো- মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নান। এরমধ্যে ৫ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে মেহেদী হাসান। প্রথমে ৩ খুনি লিটনের সাথে জরুরী কথা আছে এ কথা বলেই তার সাথে বৈঠকখানা ঘরে ঢোকে। সেখানে ঢুকেই তাকে সালাম দিয়েই ১ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে মেহেদী। যা লিটন হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। ফলে সে গুলিটি হাতে লাগে। যেহেতু এই খুনিরা পেশাদার কিলার ছিল না, সেজন্য প্রথম গুলিটি ব্যর্থ হলে খুনি মেহেদী ঘাবড়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে এলোপাথারি পরবর্তী ৪ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে। হত্যাকান্ড শেষে তাদের ব্যবহৃত ডাইং ব্রাউন্সার রানার ১০০ সিসির কালো রংয়ের মটর সাইকেলটিতে চড়ে দ্রুত পালিয়ে যায় তারা। খুনে ব্যবহৃত মটর সাইকেলটি কাদের খানের নামে রেজিষ্ট্রেশনকৃত এবং রেজিঃ বাবদ প্রদত্ত ফি জমা করা হয়েছে এমডি আলী নামে। যা পুলিশ জব্দ করেছে। এরপর রাস্তায় অপেক্ষমান কাদের খানের গাড়িতে কিলাররা বগুড়ায় তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পরে খুনিরা বাসে ঢাকায় গিয়ে কাদের খানের সহযোগিতায় আত্মগোপন করে থাকে।
যেভাবে কিলাররা সনাক্ত হয়ঃ
এমপি লিটনের কিলাররা গত ২ জানুয়ারি গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ধোপাডাঙ্গায় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ওই পিস্তলটি ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে ফাইম নামে এক যুবকের কাছ থেকে তার মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনতাই করে। ছিনতাই শেষে তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে পিস্তলের ৬ রাউন্ড বুলেটের ম্যাগাজিনটি তাদের অগোচরে রাস্তায় পড়ে যায়। যা স্থানীয় জনগণের দেয়া তথ্য অনুযায়ি পুলিশ উদ্ধার করে। এই পিস্তলের বুলেট পরীক্ষা করে দেখা যায় এমপি লিটনের শরীর থেকে অপারেশন করে বের করা এবং তার বাড়িতে হত্যার পর প্রাপ্ত বুলেটের খোসার সাথে ওই ম্যাগাজিনের বুলেটের মিল রয়েছে। পরে এই সুত্র ধরে খুনিদের আটক করা হয় এবং পিস্তলটির ব্লাষ্টিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।
গ্রেফতারকৃত ৩ খুনি মঙ্গলবার ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করে এবং এই ঘটনার মুল পরিকল্পনাকারি, অর্থ যোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও আব্দুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে। এদিকে খুনিরা কাদের খানের পিস্তলটি ব্যবহার করেছিল বলেই বিভিন্ন সুত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে ঢাকা থেকে প্রাপ্ত ব্লাষ্টিক পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর তারা চুড়ান্ত হবেন বলে ধারণা করছেন। এদিকে সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান খুনিদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক কাদের খানের পিস্তল এবং বুলেট জব্দ করে। কিন্তু ৪০ রাউন্ড বুলেট ক্রয় করলেও কাদের খান পুলিশকে মাত্র ১০ রাউন্ড বুলেট জমা দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ৩০ রাউন্ড বুলেটের হিসাব সে দিতে পারেনি।
মামলার বাদি ও লিটনের স্ত্রী সন্তোষঃ
পুলিশ কর্তৃক লিটনের হত্যার পরিকল্পনাকারি ও খুনিদের গ্রেফতার করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদি লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী। তিনি এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এই খুনের রহস্য উদঘাটনে নিয়োজিত পুলিশ ও বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান এবং খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতিও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
লিটনের খুনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এঃ
জেলা জজ আদালতে সরকার পক্ষের পিপি অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, চাঞ্চল্যকর এমপি লিটন খুনের মামলাটির জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ি দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সে কারণেই এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আদালত কর্তৃক কাদের খানের ১০ দিনের রিমান্ডঃ
বুধবার দুপুরে পুলিশ কাদের খানকে গাইবান্ধার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। শুনানী শেষে আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালতের বিচারক মইনুল হাসান ইউসুফ।