নিশা, সম্পাদনায়-আরজে সাইমুর, স্বদেশ নিউজ২৪.কম:
মুভি – সুলতানা বিবিয়ানা , কাস্ট – বাপ্পি, আঁচল, শহিদুজ্জামান সেলিম, মামুনুর রশীদ, অমিত হাসান প্রমুখ প্রযোজক – আরশাদ আদনান
কাহিনী ও সংলাপ – প্রয়াত ফারুক হোসেন পরিচালক – হিমেল আশরাফ সঙ্গীত পরিচালক – ইমন সাহা, হাবিব ওয়াহিদ, ইমরান ও আকাশ বাপ্পি – আঁচল জুটির ষষ্ঠতম মুভি ‘সুলতানা বিবিয়ানা’। মুভির শুরুতে দেখা যায় ডাকাত অমিত হাসান জেলের ভেতর বাপ্পিকে দেখে তার ওখানে থাকার কারণ জানতে চাইলে ফ্ল্যাশব্যাক থেকে কাহিনী শুরু হয়। শহিদুজ্জামান সেলিমের কাছে ফুল চাষ শিখতে আসে বাপ্পি। ফুল বাগানের মালিক মামুনুর রশীদের মেয়ে আঁচলের প্রেমে পড়ে যায় সে। প্রেম শুরুর আগেই ঘটনাক্রমে চুরির দায়ে জেলে যেতে হয় তাকে। অবশেষে এই ভুল বোঝাবুঝি শেষ হয়ে প্রেমও শুরু হয়। কিন্তু না, এখানে সুখের সমাপ্তি না, ঝামেলা তো কেবল শুরু। মুভির ক্লাইম্যাক্সে দেখানো হয় একটা খুন। কেন এই খুন? কে করল খুন? এইসব রহস্য এবং বিশ্বাস – অবিশ্বাস, সন্দেহ, রোমান্স, নাটকীয়তা, নারীর প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি, কমেডি, অ্যাকশন, নানা টুইস্ট নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সুলতানা বিবিয়ানা’। এখানে বাপ্পির নাম সুলতান আর আঁচলকে সে তার বিবি মনে করে। তাই হয়ত এত সুন্দর একটি নাম রাখা হয়েছে। মুভির শেষটুকু নিয়ে কিছু বলতে চাইনা, খুব বেশি আবেগঘন একটি মুহূর্ত সেটি। দর্শক হলে যেয়ে দেখুক সেটাই চাই। মুভিতে বাপ্পির অভিনয় বেশ ভাল হয়েছে। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে নতুনভাবে দেখিয়েছেন। যারা বলেন বাপ্পির মাঝে নায়ক হওয়ার সবগুণ আছে কিন্তু অভিনয় পারেনা, এবার তারা নড়েচড়ে বসবেন। ঢালিউডে বাপ্পির অন্য ছবির সাথে এ ছবির অভিনয় মেলালেই পার্থক্যটা বেশ চোখে পড়ে। শহিদুজ্জামান সেলিম এবং মামুনুর রশীদের মত শক্তিমান অভিনেতাদের সাথে এত সাবলীল অভিনয় সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। আঁচল দেখতে যেমন গ্ল্যামারাস, সুন্দরী তার অভিনয়ও বেশ চমৎকার হয়েছে। অভিনয়ে পরিমিতিবোধ ব্যাপারটায় তার দখল আছে। এক্সপ্রেশনেও তিনি অনবদ্য। গ্রামের মেয়ের চরিত্রে বেশ ভালভাবেই উৎরে গেছেন। বিশেষ করে শেষ দিকে অমিত হাসানের আস্তানায় বাপ্পির সম্পর্কে জানার পর ক্লোজ শটে আঁচলের এক্সপ্রেশন দুর্দান্ত। তার কস্টিউমগুলোতেও তাকে বেশ ভাল লেগেছে। শহীদুজ্জামান সেলিম এবং মামুনুর রশীদকে নিয়ে আলাদা করে কিছুই বলার নেই, তারা তাদের চরিত্রে একদম পারফেক্ট। ভালো মানুষী আছে কিন্তু একই সাথে নারীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিতেও যার ভুল হয়না এরকম একটা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। আর বাবার চরিত্রে মামুনুর রশীদকে দেখে মনেই হয়নি তিনি অভিনয় করছেন, মনে হয়েছে বাবারা তো এমনই হয়! অমিত হাসানকে নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নাই। তার জায়গা থেকে তিনি ঠিক ছিলেন। তবে আরেকটু ভাল হতে পারত। কথায় কথায় তার ‘বিউটিফুল’ ডায়লগটি দর্শক মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে। মুভির অন্যান্য চরিত্রগুলোর অভিনয়েও সাবলীলতা ছিল। আল্লাহ, আল্লাহ গানটিতে আনন্দ খালেদের পারফর্মেন্স প্রশংসনীয়। এবারে বিশেষভাবে বলতে হয় লোকেশনের কথা। বেশিরভাগ বাংলা মুভিতে একই টাইপ লোকেশন দেখে অভ্যস্ত দর্শক এ মুভিতে দেখতে পাবেন একদম ভিন্ন এবং অদ্ভুত সুন্দর লোকেশন। বাংলার সৌন্দর্য বেশ চমৎকার ফুটে উঠেছে এই মুভিতে। নদী, নদীর পাড়ে সুন্দর গ্রাম, ফুলের বাগান, সবুজ ক্ষেত এক কথায় চোখে আরাম দেওয়া গ্রামীন পরিবেশ। তবে সব ভালোর পাশাপাশি শেষ অ্যাকশন দৃশ্যটা নিয়ে একটু বলতে চাই। মার খেয়ে ভিলেন এফডিসির সেটের ধুলোর উপর পড়ছে এ দৃশ্য কেমন জানি খাপ খায়না, যেহেতু মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ফিল্ম তাই অ্যাকশন ছাড়া দর্শক কতখানি গ্রহণ করবে নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যেত তাই দৃশ্যটি আরো ভাল হওয়া উচিৎ ছিল। ঐ একই দৃশ্যে আঁচল এর মেকআপ অনেক কড়া লেগেছে। যেহেতু মুক্তির এক সপ্তাহ আগে গানের শুটিং হয়েছে তাই পুরো মুভি এবং গানে আঁচল এর ফিটনেসের পার্থক্যটা চোখে পড়েছে। মুভির সব কয়টি গানই বেশ ভাল হয়েছে। ইমরান – পড়শীর ‘বলে দাও’, কিশোর – লিজার ‘এক পলকে’, হাবিব – ন্যান্সির ‘তুমি আমার’, আকাশ সেনের কণ্ঠে ‘আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ ভালোবাসায় কি যাদু’ সব কয়টি গানই শ্রুতি মধুর। গানগুলোর দৃশ্যায়নও খুব সুন্দর। মৌলিক গল্পের এই মুভি দেখে মনে হবেনা অতি রঞ্জিত কিছু, মনে হবে এটা আপনার, আমার, আমাদের সমাজেরই গল্প। মুভির বেশ কিছু ডায়লগ বেশ উপভোগ্য। ‘আমি দুনিয়াতে আইছি তোমার জন্য, আমি বাঁইচা আছি তোমার জন্য, আমি মরমুও তোমার জন্য’ – ভালোবাসার তীব্রতা বোঝাতে এরচেয়ে সুন্দর ডায়লগ আর কি হতে পারে! মুভির আরেকটা ডায়লগ আমার মনে খুব দাগ কেটেছে- ‘সব নৌকাই একদিন ঘাঁটে ফিরে, আমার ঘাঁটের নাম কি জানো? আমার ঘাঁটের নাম সোনালী’। উল্লেখ্য আঁচল এর নাম এখানে ‘সোনালী’। মুভির দৃশ্যায়ন, এডিট, কোরিওগ্রাফি, কালার সবকিছুই ভালোলাগার মত। আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া সবকয়টি মুভির মাঝে ‘সুলতানা বিবিয়ানা’র গ্রহণযোগ্যতা দর্শকমহলে সবচেয়ে বেশি। বেশ কয়েকটি হল হাউজফুল ছিল। কোন দর্শক মুভির মাঝে হল ছেড়ে চলে যাননি, এমনকি এমন দর্শকও পাওয়া গেছে যারা ২য় কিংবা ৩য় বার এসেছেন মুভিটা দেখতে। ‘আমাদের গল্পে আমাদের সিনেমা’- শ্লোগানে মুভিটা এভাবেই তার স্বার্থকতার প্রমাণ দিয়েছে। আর এ থেকে আরো একটা ব্যাপার প্রমাণিত হল খুব ধুম ধাড়াক্কা, হৈ চৈ টাইপ তামিল, তেলেগু, বলিউড মুভির চেয়ে দর্শক দেশীয় আমেজে মৌলিক গল্পের মুভিই বেশি পছন্দ করে। এবারে লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, মুভির নির্মাতার কথা বলতে চাই। হিমেল আশরাফ এত সুন্দর আর যত্ন করে মুভিটা বানিয়েছেন যে দেখে মনেই হয়না এটা তার পরিচালনায় প্রথম মুভি। হ্যাটস অফ টু হিম। তিনি আগে টিভি নাটক নির্মাণ করতেন, আর এই টিভি নাটক নির্মাতাদের ফিল্মে আসাটা অনেকেই ভাল চোখে দেখতেন না বা দেখেন না। অথচ একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে এককালে বাংলা মুভি ধ্বংস যাদের হাত ধরে হয়েছিল সেই এফডিসির নির্মাতাদের চেয়ে টিভি নাটক নির্মাণ থেকে যারা ফিল্মে এসেছেন তারাই বাংলা মুভির সোনালী অতীত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। এ তালিকায় যুক্ত হলেন হিমেল আশরাফ। সবশেষে আমি কিছু বলতে চাই, এত ভাল একটা চলচ্চিত্র আমরা পেলাম কিন্তু শ্যামলী বা বলাকার মত হল কেন এই মুভি নিচ্ছেনা। আশা করব, মুভিটাকে আরো বেশি হিট করতে বলাকা / শ্যামলীতেও মুক্তি পাবে। আর সেই সাথে দর্শকদের জন্যও কিছু বলতে চাই। হ্যাঁ বাংলা মুভির দর্শক আগের চেয়ে বেড়েছে, মহিলা দর্শকরাও হলে যাচ্ছেন এটা খুবই আশার কথা। কিন্তু এখনো অনেক বড় একটা অংশ আছে যারা বাংলা মুভির নামে নাক ছিটকান। অশ্লীল, কিংবা দেখার কি আছে বলে এড়িয়ে যান। একদিনে তো পরিবর্তন সম্ভব না, তবুও তো দিন দিন উন্নতির পথে আমরা। আর কি হলে আপনারা প্রেক্ষাগৃহে আসবেন? আপনারা যতদিন মুখ ফিরিয়ে রাখবেন ততদিন আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব না। আমরা সবাই মিলে হলে গেলেই আমাদের নির্মাতারা আরও ভাল ভাল নির্মাণে উৎসাহী হবেন। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের।