ক্রিকেট এবং জীবন- দুই গ্রহেই তাদের গল্পটা আলাদা। একজন শান্ত, সৌম্য। আরেকজন মেজাজি, ঔদ্ধত্য। একজনের ব্যাট যেন বলকে আলতো আদর করে। মায়ার জাল বুনে। অন্যজনের ব্যাটিং হয়তো চোখে মায়ার জন্ম দেয় না। কিন্তু আগ্রাসী। আনন্দদায়ী। মুহূর্তেই বদলে দেয় ম্যাচের গতি।
কিন্তু শুক্রবারের কার্ডিফ সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে এলো একই কেন্দ্রবিন্দুতে। তাদের ২২৪ রানের জুুটি এক ঐতিহাসিক, অনন্য, অসাধারণ বিজয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। এ জুটিতে কত কত রেকর্ড হয়েছে- তা ক্রিকেট ভক্তরা এরই মধ্যে জেনে গেছেন। অথচ পরিস্থিতি কী দুরূহই না ছিল। ৪০ পূরণ হওয়ার আগেই দলের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের বিদায়। সাউদি-বোল্ট রীতিমতো সুইংয়ের প্রদর্শনী দেখাচ্ছিলেন। ২৬৫ রানের টার্গেট তাড়ায় তখন সাকিব-মাহমুদুল্লাহ জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন কি-না কে জানে। কী যে কাজ করছিলো তাদের মনে। পরে অবশ্য সাকিব বলেছেন, ভাবনা ছিল যতক্ষণ সম্ভব ব্যাটিং করতে থাকা। অনেক ওভার বাকি ছিল। ইদানীং তো বেশি ওভার ব্যাটিংই করতে পারি না। ইচ্ছে ছিল তাই যত বেশি সম্ভব ব্যাটিং করা। রিয়াদ ভাই এসে খুব ভালো ব্যাটিং করলেন। তিনি এসেই আমার ওপর থেকে চাপ সরিয়ে নেন। সাকিব আরো বলে যান, যখন দেখলাম ১০০-১১০ রানের জুটি হয়ে গেল, আশা দেখলাম। এক পর্যায়ে ২০-২২ ওভারে ১৩০-১৪০ রানের মতো লাগতো। টি-টোয়েন্টি অনেক খেলি, ওভার প্রতি ৭ করে রান খুব সমস্যা নয়। ভাবলাম আমরা দুজনে যদি এই ২০ ওভার ব্যাট করি, তাহলেই হয়ে যাবে, সেটা আমরা করতে পেরেছি।
আর মাহমুদুল্লাহ বলেন, ওর (সাকিব) সঙ্গে ব্যাটিংয়ের অন্য মজা। সবসময়ই অনুভব করি এটা। ওর সঙ্গে ব্যাটিংয়ের সময় অত কথাবার্তা হয় না। ও হয়তো ওর মতো বলে, ‘রিয়াদ ভাই ঠিক আছে, খেলে যান।’ আমিও বলি সাকিব ঠিক আছে। এতটুকুই। আজকেও একইরকম ছিল। আমরা চুপচাপ ব্যাটিং করে গেছি। শেষের দিকে বোল্ট যখন ফিরলো, তখন একটু বলেছি যে, এখন সুইং করছে। মিলন এলো, বল একটু রিভার্স করছিল। এসব নিয়ে টুকটাক কথা। এর বেশি কিছুই নয়।
সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিং বীরত্বের পর ক্রিকেট বোদ্ধা আর সাবেক ক্রিকেটাররা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন সম্ভবত ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে। এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ সফরে গিয়ে দলগুলো চাইতো বাংলাদেশ আগে ব্যাটিং করুক। খেলাটা যাতে আগে শেষ হয়ে যায়। কী দারুণভাবেই না পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন এমন জুটি অতীতে দেখেছেন কিনা মনে করতে পারছেন না। তিনি লিখেছেন, ওয়ানডে ক্রিকেটে এর চেয়ে সেরা জুটির কথা আমি মনে করতে পারছি না। ৩৩ রানে ৪ উইকেট নেই। বল সুইং করছে এমন পরিস্থিতিতে এই জুটি।
দুই ভিন গ্রহের কথা বলেছিলাম শুরুতেই। কথাটি দু’ভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গে কার্ডিফের নাম জড়িয়ে গেছে বহু আগেই। মোহাম্মদ আশরাফুলের সেই ঐতিহাসিক সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়া বধ তো ক্রিকেট রূপকথার ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে। প্রায় এক যুগ আগের সে ম্যাচে খেলা মাশরাফিই কেবল ছিলেন এ ম্যাচেও। সেই ম্যাচের কথা এখনো ভালোভাবেই মনে করতে পারেন তিনি। নিশ্চিত করেই বলা যায় জীবদ্দশায় কখনো ভুলতে পারবেন না। শুক্রবার রাতে কার্ডিফে সাকিব-মাহমুদুল্লাহ যা দেখালেন তাও ভোলার নয়। ভিনগ্রহের ক্রিকেট তো একেই বলে।
ইংরেজিতে একটি কথা ইদানীং খুব শোনা যায় ‘ফেমাস উইন।’ নিশ্চিত ভাবেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয় আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ফেমাস উইন। এই জয়ের দুই কারিগরের জীবনের গল্পটা অবশ্য আলাদা। সাকিব আল হাসান গত এক দশক ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা। হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরও। পৃথিবীর হাতেগোনা দুই/তিন জন অলরাউন্ডারদের মধ্যে রয়েছে তার নাম- যিনি শুধু ব্যাটিং অথবা শুধু বোলিং নিয়ে দলে থাকার যোগ্যতা রাখেন। আইসিসি র্যাংকিংয়েও বারবার শীর্ষ অলরাউন্ডারের খেতাব পেয়েছেন সাকিব। সাকিবের ব্যাটিং অবশ্য দেখার জন্য মনোমুগ্ধকর নয়। সাকিব যতোটা শিল্পী তার চেয়ে বেশি আগ্রাসী। বল হাতেও বার বার জাদু দেখিয়েছেন। তবে আচরণের জন্যও সাকিব শিরোনাম হয়েছেন। কখনো তিনি ভুল করেছেন, কখনো তাকে ভুল বোঝা হয়েছে। তবে সাকিব যে একটু আলাদা সেটা হয়তো মানতেই হবে। চ্যাম্পিয়নরা অবশ্য একটু আলাদাই হয়। গত কয়েকদিন ধরে সাকিবের ফর্ম নিয়ে কিছুটা সমালোচনা হচ্ছিল। এসব দিকে অবশ্য তিনি দৃষ্টি দেননি। নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। এবং আসল লড়াইয়ের দিনে ঠিকই জবাব দিয়ে দিলেন। এই একটি বিষয়ই চ্যাম্পিয়নদের অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে।
মাহমুদুল্লাহ সাকিবের মতো হয়তো বড় সুপারস্টার নন। তবে ব্যাট হাতে রীতিমতো শিল্পী। মায়াবি ব্যাটিং খুব সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করে তাকে। মাহমুদুল্লাহর আরেকটি বিষয়ও চমকপ্রদ। বড় উপলক্ষ তার খুবই প্রিয়। বিশ্বকাপে দু’টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন। তবে মাহমুদুল্লাহর সাম্প্রতিক ফর্ম নিয়ে দলের ভেতরে অসন্তোষও ছিল। শ্রীলঙ্কা সফরে কত কিছুই না হয়ে গেল। তাকে দল থেকে বাদও দিতে চেয়েছিলেন থিঙ্কট্যাঙ্ক। কিন্তু বাদ সাধেন মাশরাফি। মাশরাফির বাধার কারণেই দলে টিকে যান। ত্রিদেশীয় সিরিজে ব্যাট হাতে ছিলেন স্বাচ্ছন্দ্য। তবে চলতি টুর্নামেন্টে প্রথম দুই ম্যাচে ছিলেন অনুজ্জ্বল। অবশ্য তাকে ৭-৮-এ নামানোর সমালোচনাও করেন অনেক ক্রিকেট বোদ্ধা। মাহমুদুল্লাহর মতো ক্লাস খেলোয়াড়ের আরো উপরে ব্যাটিং করা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। তবে অবহেলার জবাব দেয়ার জন্য মাহমুদুল্লাহও বেছে নিলেন বড় উপলক্ষকেই। এক সেঞ্চুরিতে মুখ বন্ধ করে দিলেন অনেকের।
সব দিন সবার সমান যায় না। সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ফর্মও সব সময় সমান যাবে না। কিন্তু যে মহাকাব্য তারা রচনা করেছেন তার প্রভাব চিরকালই রয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। জীবনে অথবা খেলায় বিপর্যয়ে কিভাবে লড়াই করতে হয় দেখতে কার্ডিফের সাকিব-মাহমুদুল্লাহকে দেখুন।