গ্রামের নাম ভবানীপুর। মাছে-ভাতে বাঙালি- এই প্রবাদ পুরোপুরি মিলে যায় এ গ্রামের সাড়ে ছয় হাজার মানুষের সঙ্গে।
কারণ, পাবনার বেড়া উপজেলার এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদী ও যমুনার শাখা খালগুলোতে রয়েছে মাছের প্রাচুর্য। তা থাকলে কী হবে?
মাছ-ভাত না হয় পাওয়া গেল, খাবার পানির কী হবে? গ্রামের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা তখন সর্বোচ্চ ১৫০ পিপিবি।
খাবার পানি সংগ্রহ করতে হতো প্রায় তিন-চার কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে। ভবানীপুর ছাড়াও আশপাশের ৪৪টি গ্রামের মানুষকে হিমশিম খেতে হতো বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে।
এই ‘আর্সেনিক’ আতঙ্ক এখন দূর হয়েছে, গ্রামবাসী আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি তৈরি ও ব্যবহার করে অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ সবই সম্ভব হয়েছে ‘ডেপ্লয়মেন্ট অব আর্সেনিক রিমুভাল টেকনোলজি প্রজেক্ট’ বা ডারট প্রকল্পের কারণে।
তবে এখনও বেড়া উপজেলার বেড়া পৌরসভা, জাতসাকিনী, পুরানভারেঙ্গা, কৈটলা, নতুনভারেঙ্গা ও চাকলা ইউনিয়নের এক লাখ ৫০ হাজার ৮৫৫ জন মানুষ জেনেশুনে আর্সেনিকযুক্ত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার জানাচ্ছেন, এর কারণ, এসব এলাকায় সরকারি বা কোনো বেসরকারি সংস্থা সচেতনতা বাড়ানোর কাজ ছাড়া অন্য কোনো প্রকল্প নিতে পারেনি।
আশির দশকে পাবনার বেড়া উপজেলার রূপপুর, মাসুমদিয়া, সুজানগর উপজেলার আহমেদপুর, ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর ও শাহপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান শতাধিক ব্যক্তি।
এ সময় এ রোগ ‘অজ্ঞাত রোগ’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটিকে আর্সেনিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর পর এ এলাকাজুড়ে আর্সেনিক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে আর্সেনিক নিরাময়ে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
ওসাকার বেড়া উপজেলা সমন্বয়কারী মুন্সী মাহবুবুর রহমান জানান, ২০০৮ সালে ইউনিসেফ এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগের সহায়তায় ‘আর্সেনিক রিমুভাল টেকনোলজি প্রজেক্ট’ বা ডারট প্রকল্পের আওতায় তারা কার্যক্রম শুরু করেন।
এ সময় তারা বেড়া উপজেলার মাসুমদিয়া ও রূপপুর ইউনিয়নে জরিপের কাজ করেন। তারা এ দুটি ইউনিয়নের ১৬ হাজার ৬৬৮টি টিউবঅয়েলের মধ্যে আট হাজার টিউবওয়েল পরীক্ষা করে ৫০১৯টি টিউবওয়েলে পিপিবির ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিকের সন্ধান পান।
অথচ মানবদেহে সহনীয় ০.০৫ পিপিবি মাত্রার আর্সেনিক। এ দুটি ইউনিয়নের ৪৪টি গ্রামের ৪৪ হাজার ৯৭৬ মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানা যায় এবং ৯৬ জন আর্সেনিক রোগী শনাক্ত করা হয়।
তখন এ দুটি ইউনিয়নকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নিয়ে আর্সেনিকমুক্ত পানি ব্যবহার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। আর্সেনিকমুক্ত পানি পেতে এ এলাকায় ১৪টি সিডকো প্লান্ট স্থাপন এবং জনসাধারণের মধ্যে নামমাত্র দামে ৬০০ সনো ফিল্টার, ৬০০ অ্যালকান ফিল্টার ও ৫৪টি রেড এফ ফিল্টার বিতরণ করা হয়।
এতে এ এলাকার মানুষজন এখন ঘরে বসেই আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি তৈরি এবং পান করছেন। পাওয়া যাচ্ছে খাওয়ার উপযোগী পানি।
বেড়া উপজেলার রূপপুর ইউনিয়নের ভূইয়াপাড়া গ্রামের আজিবর রহমান গিয়াস (৬১) এবং তার স্ত্রী আছিয়া খাতুন (৫২) ২০ বছর আগে আর্সেনিকে আক্রান্ত হন।
জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা তাদের পর্যবেক্ষণ করেন। আগে তাদের হাতে ও পায়ে দগদগে ঘা এবং বড় বড় ফাটা ছিল। সব সময় সারা শরীর চুলকাতো। এখন তাদের রোগ ভালো হওয়ার পথে।
আছিয়া খাতুন জানান, শাক-সবজি ফলমূল, পুষ্টিকর খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি পান করায় এখন অনেকটাই সুস্থ তারা। অথচ তারা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেননি, এই রোগ ভালো হবে।
রূপপুরেরই ভবানীপুর গ্রামে গিয়ে সরেজমিনে দেখা গেল, সিডকো প্লান্ট বসানো হচ্ছে। এ গ্রামের ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার সেখান থেকে পানি নিচ্ছেন। দীপালি রানী জানান, তারা এই পানি দিয়ে খাওয়া (পান) এবং রান্নার কাজ করেন।
পানি ব্যবহারকারীদের নিয়ে সমিতি গঠন করা হয়েছে। তারা প্রতি মাসে ১০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেন। তা ছাড়া যারা গরিব সদস্য রয়েছেন তাদের বিনা মূল্যে পানি দেওয়া হয় বলে জানালেন সমিতির সভাপতি অনিল কুমার সাহা।
সিডকো প্লান্টের কেয়ারটেকার সুনীতি রানী দাস জানান, প্রতিদিন প্রায় ৮-৯শ’ লিটার পানি ওঠানো হয়। ওষুধের সাহায্যে পানি আর্সেনিকমুক্ত করা হয়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তবিবুর রহমান তালুকদার জানান, এ অঞ্চলের একটি গ্রামেই ৫৪ জনসহ গত তিন দশকে শতাধিক ব্যক্তি আর্সেনিকের কারণে মারা গেছেন। জনস্বাস্থ্য বিভাগ এ অঞ্চলকে আর্সেনিকমুক্ত করতে প্রকল্প হাতে নেয়।
নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, আর্সেনিকযুক্ত পানি একটানা পান করলে ২০ থেকে ২৫ বছর পর ওই ব্যক্তি আর্সেনিকে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে টানা ১০ বছর আর্সেনিকযুক্ত পানি খাওয়ার পরও যদি ওই ব্যক্তি আরও ১০ বছর স্বাভাবিক বা বিশুদ্ধ ভালো পানি পান করেন, তা হলে আর্সেনিক ভালো হয়ে যায়।
পুষ্টিকর খাবার, শাক-সবজি, ফলমূল খেলে এবং আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করলেও এ রোগ ভালো হয়ে যায়।