নির্বাচনের আগে ভোটারদের সামনে উন্নয়ন দেখাতে বড় বড় প্রকল্পে এরই মধ্যে বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়েছে। বড় ১০ প্রকল্পের বরাদ্দই ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতা যেমন বাড়ানো হচ্ছে, বাড়ছে সুবিধাভোগীর সংখ্যাও।
সবকিছু মিলিয়ে আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বিশাল বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বাজেটের আকার হতে পারে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগের বারের আকার ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। ৩ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট। একে ভিত্তি ধরলে নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী নিজেও সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী বাজেটে তেমন কোনো পরিবর্তন আনছেন না তিনি। জাতীয় সংসদে ৭ জুন বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী। এর ছয় মাস পর জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। ফলে পুরো একটি অর্থবছরের বাজেট দিলেও অর্থমন্ত্রীর বড় নজর থাকবে মূলত প্রথম ছয় মাস।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এমন কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে নির্বাচনকে মিলিয়ে দেখা যায়। আবার আগামী বাজেটে যে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না—এ থেকেও বুঝে নেওয়া যায় এটা নির্বাচনী বাজেট কি না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারাও বলছেন, বড় বাজেট করতে গেলে বড় রাজস্বের দরকার। দরকার রাজস্ব সংগ্রহের নতুন নতুন উৎস। নির্বাচনী বাজেট বলেই সরকার সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনী বছর বলেই সরকারের জন্য এবারের চ্যালেঞ্জটা একটু বেশি। এবারও আয়-ব্যয়ের লক্ষ্য বড় রাখা হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে ব্যয় ঠিকই করতে হবে, কিন্তু আয় তত না-ও হতে পারে।
একই ধরনের মতামত আরেক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নির্বাচনের কারণে করদাতাদের ওপর নতুন করে কর চাপানো হবে না, বরং কর ছাড়ই দেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদেরা আরও বলছেন, ৯ বছরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি ছাড়া বড় ধরনের নীতি সংস্কার হয়নি। এবারও আকারই বাড়ছে। তবে এখনো কর-জিডিপির নিম্নতম হার নিয়েই চলছে দেশ। চালু হয়নি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাও, যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতে পারত। অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে নিয়ে তিনি যে ‘নব উদ্যোগ বিনিয়োগ প্রয়াস’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তারও তেমন কিছুই হয়নি। গভীর কোনো অনুসন্ধান হয়নি ব্যাংক খাতের লুটপাট নিয়ে।
এনবিআরের লক্ষ্য ৩ লাখ কোটি টাকা
আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে। সে হিসাবে এনবিআরকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য থেকে ৭১ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে তা প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। এনবিআর কখনোই রাজস্ব আদায়ে এত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি।
বরাবরের মতো আগামী বছরেও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে আদায় করতে হবে সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এরপরই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আয়কর আদায় করা হবে ১ লাখ ২০০ কোটি টাকা। আর শুল্ক খাতে এনবিআরকে ৮৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ নেয়, যার মধ্যে বেশি ঋণ নিয়ে থাকে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই। ঘাটতি মেটাতে এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও ভালো একটা টাকা সংগ্রহ করে সরকার। উন্নয়ন ব্যয় বাদ দিলে অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে আগামী বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ঋণের সুদ পরিশোধ এবং ভর্তুকিতেই ব্যয় হয়ে যাবে এক-তৃতীয়াংশ। এর পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্য অর্জন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনের কারণে সরকার রাজস্ব খাতে বড় কোনো সংস্কার আনতে পারবে না। তাই রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যের ধারেকাছেও যাবে না এনবিআর। তা ছাড়া রাজস্ব আদায় তো মুখের কথায় হবে না। ভ্যাট, আয়কর ও শুল্ক—এই তিন নতুন আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।
এডিপি ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার
নতুন অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে যা গতবারের চেয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) আওতায় থাকবে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি, যা মূল এডিপি হিসেবে পরিচিত। বাকিটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প।
নির্বাচন সামনে রেখে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সরকারের অগ্রাধিকারের ১০টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দ। আর পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের জন্য রাখা হয়েছে যথাক্রমে ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি ও ৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। নতুন এডিপির ২৬ শতাংশ বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে পরিবহন খাতে। নির্বাচনের বছরে রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রকল্পেই সাংসদদের আগ্রহ বেশি।
সব মিলিয়ে আগামী এডিপিতে ১ হাজার ৪৫২টি প্রকল্প আছে। এ ছাড়া এডিপিতে বরাদ্দহীন ও অননুমোদিত প্রকল্প আছে ১ হাজার ৩৩৮টি। এই প্রকল্পগুলো থেকে সারা বছর একনেকে পাস করা হবে।
ভ্যাট হার কী হবে
চলতি অর্থবছরের ১৫ শতাংশ একক ভ্যাট হার বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেন। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন আইন চালু হবে।
কিন্তু আগামী বাজেটেই ভ্যাট হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে নয়টি ভ্যাট হার আছে। এটি কমিয়ে ছয়টি হারে নামানো হতে পারে। বর্তমানে দেড়, আড়াই, ৩, ৪, সাড়ে ৪, ৫, ৬, ১০ ও ১৫—এই ৯টি হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে গণনা করা হয় এসব হার।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এই হার হতে পারে ২, ৩, ৪, ৬, ১০ ও ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
রাজস্ব খাতে সম্ভাব্য পরিবর্তন
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর হার কিছুটা কমানো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হার আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে। তবে অর্থমন্ত্রী আগামী কয়েক বছরে সার্বিকভাবে করপোরেট কর হার কমিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা দেবেন।
আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদেরও কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। বর্তমানে শূন্য, ১০, ১৫, ২০, ২৫ ও ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে ৫ কিংবা সাড়ে ৭ শতাংশ হারে আরেকটি কর স্তর রাখা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিচের দিকের করদাতাদের ওপর করের চাপ কিছু কমবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বৃদ্ধির রাজনৈতিক চাপ আছে। সেটি করা হলে করমুক্ত আয়সীমা পৌনে ৩ লাখ টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো কর দিতে হয় না। তবে কর স্তর বাড়িয়ে দিয়ে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি না করার পক্ষে এনবিআরের অবস্থান।
গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম কর্তৃপক্ষের আয়কর কীভাবে নেওয়া হবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না। ডিজিটাল বাজারজাতকরণ খাত দেখিয়ে এসব খাত থেকে আয়কর নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে এনবিআর। এদিকে এসব সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ থাকলেও তা আদায় করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকবে বাজেটে।
এ ছাড়া ট্যারিফ মূল্যে ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে। বর্তমানে চিনি, চা, বিস্কুট, চিপস, শ্যাম্পু, সাবান, মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয়, জুসসহ ৪২২ ধরনের পণ্যে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্যারিফ মূল্যের এই সংখ্যা কমিয়ে ৩০০-এর মতো করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যেসব পণ্যের বাজারমূল্যের চেয়ে ট্যারিফ মূল্য কম দেখানো হয়, সেগুলো বাদ যাবে। আবার কম দামি রুটি-বিস্কুটের ভ্যাট ছাড় দেওয়া হতে পারে।
রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা থাকবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। বিশেষ করে উৎসে কর আহরণের জন্য আলাদা কর অঞ্চল গঠন করার ঘোষণা থাকবে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি কর অঞ্চল গঠন করা হবে। বর্তমানে ৩১টি কর অঞ্চল আছে।
এ ছাড়া আগামী অর্থবছর থেকে নতুন কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা ছিল এনবিআরের। এর আগে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে নতুন আইনটি পাস করার কথা। কিন্তু আগামী সংসদে অধিবেশনে নতুন কাস্টমস আইনটি উত্থাপন করা হচ্ছে না। মূলত প্রস্তুতির অভাবে এবং নির্বাচনের বছরে এ ধরনের একটি আইন পাস করতে আগ্রহী নয় সরকার।