‘ইনিংস ও ১৮৪ রানের জয়!’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই জয়ে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। টেস্ট আঙ্গিনায় ১৮ বছরের পথ চলায় টাইগারদের খেলা হয়েছে ১১২ ম্যাচ। সেখানে প্রতিপক্ষকে ফলোঅনে পাঠিয়ে এমন গর্বের জয় এবারই প্রথম। তাই গতকালের পাওয়া ১৩তম জয় হয়ে থাকবে টাইগার ক্রিকেটে মাইলফলকও। প্রাপ্তির এখানেই শেষ নয়।
বাংলাদেশ সফরে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবারই প্রথম টেস্ট হারে। সেই সঙ্গে সিরিজ হেরে হয়েছে হোয়াইটওয়াশও। চট্টগ্রাম টেস্টে জয় এসেছিল ৬৪ রানে। এরপর ১-০ তে এগিয়ে ঢাকা টেস্টে ছিল সিরিজ জয় ও হোয়াইটওয়াশের হাতছানি।গতকাল ক্যারিবীয়দের তিনদিনে হারিয়ে সেটিও নিশ্চিত হয়েছে। সেই সঙ্গে নেয়া হয়েছে পাঁচ মাস আগে ২-০ তে সিরিজ হারের মধুর প্রতিশোধও। বাংলাদেশকে পেয়ে নিজ মাটিতে পেস উইকেটে নাকাল করেছিল ক্যারিবীয়ানরা। সাকিবের দলকে মুখোমুখি হতে হয় ইনিংসে মাত্র ৪৩ রানে গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জায়। এবার নিজেদের মাটিতে গতির আক্রমণের সে অপমান ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে স্পিন জাদুতে। চট্টগ্রাম ও মিরপুরের উইকেটে স্পিন ফাঁদ পেতে চার স্পিনার করেছেন ঘূর্ণির উদ্দাম নৃত্য।
মেহেদী হাসান মিরাজ, সাকিব, নাঈম হাসান ও তাইজুল ইসলামদের সামনে মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশেষ করে ঢাকা টেস্টে তরুণ অফস্পিনার মিরাজ দুই ইনিংসে একাই নেন ১২ উইকেট। এমন বোলিংয়ে মিরাজ স্পর্শ করেছেন নতুন রেকর্ডও। বলার অপেক্ষা রাখেনা ম্যাচ সেরা তিনিই। এ ছাড়াও সাকিব নিয়েছেন ৪টি ও তাইজুল ৩টি উইকেট। ২০০৯ এ সাকিবের নেতৃত্বেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। সেটিই ছিল বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জয়। এবারো সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো সাকিবের হাত ধরে। তবে সেটি দেশের মাটিতে। বল ও ব্যাট হাতেও ছিল দারুণ অবদান তাই স্বাভাবিক ভাবেই সিরিজ সেরা হয়েছেন টাইগার অধিনায়কই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে অধিনায়ক সাকিবের প্রতিজ্ঞা ছিল হারের যন্ত্রণা ফিরিয়ে দেয়ার। তাই সতীর্থদের মনে রাখতে বলেছিলেন সেই হারের ক্ষতের কথা। ক্যারিবীয় স্পিন দুর্বলতা যে বাংলাদেশের অন্যতম শক্তি! যে কারণে প্রথমবারের মতো চার স্পিনার নিয়ে মাঠে নেমেছিল চট্টগ্রাম টেস্টে। মাত্র আড়াই দিনেই স্পিনে নাকাল হয়ে হেরে যায় ক্যারিবীয়রা। সেই ম্যাচে একমাত্র পেসার মোস্তাফিজুর রহমান মাত্র ৪ ওভার বল করেছিলেন। তাই ঢাকা টেস্টে বোলিং আক্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করে বাংলাদেশ। এবারই প্রথম নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে কোনো পেসার ছাড়া মাঠে নামেন টাইগাররা। শঙ্কা ছিল কি হয়! কিন্তু রেকর্ড হয়েছে আর এসেছে দাপুটে জয়ই।
মিরপুর শেরে বাংলা মাঠে টসে জিতে ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষিক্ত ওপেনার সাদমান ইসলাম অনিকের পর সাকিব ও লিটন কুমার দাসের ফিফটির সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যোগ করেছিলেন অসাধারণ এক সেঞ্চুরি। তাতেই প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের স্কোর বোর্ডে যোগ হয় ৫০৮ রান সবক’টি উইকেট হারিয়ে। ব্যাটিংয়ে নতুন রেকর্ডও হয়, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ১১ জনই এক ইনিংসে দুই অঙ্কে পৌঁছায় এই প্রথম। টানা দেড় দিন ব্যাটিংয়ের অনন্য নজিরও দেখান তারা। সেখানেই শেষ নয় দ্বিতীয় দিন শেষ বিকালে বল হাতেও ঢুকে পড়ে ১২৮ বছর আগের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে। জবাব দিতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাত্র ২৯ রানেই হারায় ৫ উইকেট। আর এই পাঁচজনকেই বোল্ড করে বিদায় করেন সাকিব ও মিরাজ। এমন ঘটনা শেষ ঘটেছিল ১৮৯০ সালে।
৭৫ রানে ৫ উইকেট হারানো ক্যারিবীয়দের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল ২৩৪ রান করে ফলোঅন এড়ানোর। কিন্তু তৃতীয় দিন সকালে বাকি পাঁচ উইকেট হারায় মাত্র ৩৬ রান তুলতেই। মাত্র ১১১ রানে প্রথম ইনিংসে অলআউট হওয়া ক্যারিবীয়দের জন্য তাই নিশ্চিত ফলোঅন। এবারই প্রথম বাংলাদেশ কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশকে ফলোঅনে পাঠায়। ৩৯৭ রানে পিছিয়ে থাকা সফরকারীদের সামনে দ্বিতীয় ইনিংসে চ্যালেঞ্জ ছিল ইনিংস হার বাঁচানোর। কিন্তু সেখানেও মরণ কামড় দেন মিরাজ। মাত্র ২৯ রানেই হারায় ৪ উইকেট। শেষ পর্যন্ত স্পিন বিষে নীল হয়ে দ্বিতীয় ইনিংস থামে ২১৩ রানে।
লড়াই করেছেন একমাত্র তরুণ হেটমায়ার। তবে তারই বন্ধু মিরাজকে উইকেট দিয়ে এই সিরিজে টানা চতুর্থ বার উইকেট দিয়ে থেমেছেন। দলের পক্ষে করেছেন সর্বোচ্চ ৯৩ রান ও ৯২ বলে। এই ম্যাচের দুই দলের তিন ইনিংসে ছক্কা এসেছে ১০টি। যার ৯টিই ছিল তার এই ইনিংসে। তবে এতে শুধু পরাজয়ের ব্যবধানই কমেছে হারের লজ্জা নয়।