জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চলছিল তুমুল লড়াই। শেষ পর্যন্ত সে লড়াইয়ে হেরে গেলেন বরেণ্য কাহিনিকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, চলচ্চিত্র ও নাট্য পরিচালক এবং অভিনেতা আমজাদ হোসেন। জাগতিক সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেলেন তিনি। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এ কিংবদন্তি (ইন্নালিলাহি…রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলে রেখে গেছেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় গত ১৮ই নভেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আমজাদ হোসেনকে। হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।শুরু থেকেই তাকে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। বরেণ্য এই নির্মাতার শারীরিক অসুস্থতার খবর শুনে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মাথায় তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমজাদ হোসেনের উন্নত চিকিৎসার খরচ বাবদ ২০ লাখ টাকা এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাবদ ২২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পরিবারের হাতে তুলে দেন তিনি।
এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭শে নভেম্বর মধ্যরাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে আমজাদ হোসেনকে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় তার সঙ্গে যান তার দুই ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল ও সোহেল আরমান। সেখানে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে তিনি প্রখ্যাত নিউরোসার্জন টিরা ট্যাংভিরিয়াপাইবুনের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশীয় চলচ্চিত্রের এই বরেণ্য ব্যক্তির মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, প্রযোজক পরিবেশক সমিতি, ডিরেক্টর গিল্ডস, ফিল্ম ক্লাব, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি, বাচসাসসহ অনেকেই শোক জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ই আগস্ট, জামালপুরে।
শৈশব থেকেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত হন। প্রথমেই তিনি অভিনয়ে নিজেকে তুলে ধরেন মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে। এর পরপরই তিনি অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে। তবে এরপরের ইতিহাসটা একেবারেই অন্যরকম। পরিচালক সালাহ উদ্দিন আমজাদ হোসেনের লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এতে আমজাদ হোসেন নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। এরপর তিনি বরেণ্য নির্মাতা জহির রায়হানের ইউনিটে কাজ শুরু করেন। এভাবেই দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে ১৯৬৭ সালে তিনি নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। নাম ‘জুলেখা’।
এরপর নূরুল হক বাচ্চুর সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন ‘দুই ভাই’। তার পরিচালিত ব্যাপক দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি। আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো হচ্ছে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ (১৯৬৭), ‘দুই ভাই’ (১৯৬৮), ‘নয়নমণি’ (১৯৭৬), ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৭৮), ‘সুন্দরী’ (১৯৭৯), ‘কসাই’ (১৯৮০), ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ (১৯৮২), ‘দুই পয়সার আলতা’ (১৯৮২), ‘ভাত দে’ (১৯৮৪), ‘হীরামতি’ (১৯৮৮), ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ (১৯৯৪), ‘কাল সকালে’ (২০০৫) ও ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ (২০১০) । শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (১৯৯৩) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। আমজাদ হোসেন বেশ কিছু টিভি নাটকও নির্মাণ করেন। বিশেষ করে তার নির্মিত ‘জব্বার আলী’ সিরিজের নাটকগুলো আকাশছোঁয়া দর্শকপ্রিয়তা পায়। এসব নাটকে জব্বার আলী চরিত্রে অভিনয় করে আমজাদ হোসেন নিজেও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।