ঘরে ডেঙ্গু রোগী। আশপাশেও অনেকের ডেঙ্গু জ্বর। সঙ্গে শরীর ব্যথা। বমি। তারপরও তারা জানেন না তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত। তাই ছুটে যাচ্ছেন কবিরাজের কাছে। ডাব পড়া, পানি পড়া ও কাইতন পড়া দিয়ে চিকিৎসা চালান। অবস্থা যখন বেগতিক তখনই তারা ছুটে যান গলির মুখের ফার্মেসিতে।
তখনই জানতে পারেন তাদের জ্বর সাধারণ কোনো জ্বর নয়। ডেঙ্গু জ্বর। মশার কামড় থেকে এ জ্বরের উৎপত্তি। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি ও নিম্নাঞ্চল ঘুরে এমন চিত্রই জানা গেছে। হাজারীবাগের বৌ বাজার, রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের পাশের বস্তিতেও ডেঙ্গু হানা দিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু ডেঙ্গু সম্পর্কে বস্তিবাসী অসচেতন বলেই যথাসময়ে সুচিকিৎসা নিতে পারছে না তারা।
হাজারীবাগ বৌ বাজার এলাকার বাসিন্দা রোজিনা আক্তার। গত সোমবার থেকে জ্বরে আক্রান্ত। পুরো শরীর ব্যথা, জ্বরের সঙ্গে বমি। স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় স্বামী রফিকুল ছুটে যান কবিরাজের কাছে। নিয়ে আসেন ডাব, পানি ও কাইতন পড়া। তবে এসব ব্যবহারের পরও রোজিনার জ্বর ভালো হয় না। একদিন পর মোহাম্মদপুরের একটি ক্লিনিকে সিবিসি প্লাটিলেট টেস্টে তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। রোজিনা বলেন, বাসায় ৪-৫ দিন ধরে একটি বালতিতে খাবারের পানি জমিয়ে রেখেছিলাম। পরিষ্কার পানি জমিয়ে রাখলে যে ডেঙ্গু মশা জন্মায় তা জানতাম না। রফিকুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। পরিবারের কারো জ্বর হলে সাধারণত কবিরাজি চিকিৎসা বা সর্বোচ্চ হলে প্যারাসিটামল সেবন করেন।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার নানা কর্মসূচি হাতে নিলেও বস্তি এলাকায় এখন পর্যন্ত এর ছোঁয়া পাওয়া যায়নি। বৌ বাজার বস্তির বাসিন্দা ঈসমাইল জানান, সব জায়গায় ডেঙ্গু জ্বর নিয়া কর্মসূচি দেয় সরকার। কিন্তু আমাগোর এখানো একদিনও কাউরে আসতে দেখিনি। এখানকার অনেকেই জানে না ডেঙ্গু সম্পর্কে। ইতিমধ্যে অনেকেরই জ্বর হইছে। সবাই মনে করছে সচরাচর যে জ্বর হয় সেটাই হইছে। কিন্তু পরে হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষা করার পর প্রায় সবারই ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।
চলতি মাসে বৌ বাজার বস্তির অধিকাংশ পরিবারে কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এই জ্বর ‘ডেঙ্গু জ্বর’ কিনা তা কেউই পরীক্ষা করে দেখছেন না। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই কবিরাজি চিকিৎসা ও প্যারাসিটামল গ্রহণ করছেন। তাই কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে থাকলেও তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
হাজারীবাগ এলাকার ইকবাল মেডিসিন ফার্মেসির মালিক সোলাইমান হোসেন বলেন, চলতি মাসে চার জনকে ক্লিনিকে গিয়ে ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা করতে বলেছিলাম। এর মধ্যে দু’জনের ডেঙ্গু পজিটিভ এসেছে। আর বাকি দু’জন টেস্ট করাতে যাননি। অনেকেই জ্বর ও হাত পায়ের ব্যথার ওষুধ নিচ্ছেন। কিন্তু ডেঙ্গু টেস্ট করতে বললে তারা করায়নি। বস্তির শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানান তিনি।
বস্তির আরেক বাসিন্দা কামরুল মিয়া বলেন, ‘আমরা বস্তির মানুষ নিম্ন শ্রেণির ও অশিক্ষিত। তাই জ্বর হলেও টেস্ট করাতে যাই না। বেসরকারি ক্লিনিকে টেস্ট করাতে গেলে টাকার কথা শুনলে ভয় লাগে। কপালে যা আছে তাই হবে, টেনশন নাই।’
বস্তির আরেক বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, বস্তিতে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোন মাথাব্যথা নেই। ডেঙ্গু জ্বরের নাম শুনেছে অনেকে। কিন্তু এই জ্বর সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না। জ্বর হলে ফার্মেসিতে যাচ্ছে ওষুধ নিয়ে চলে আসছে। এই জ্বর যে ডেঙ্গু হতে পারে এটা কেউই চিন্তাও করছে না।
সিএনজি চালক সেলিম রেজা (৩৫)। রায়ের বাজার বেড়িবাঁধের পাশের বস্তিতে বাবলু দারোগার বাসায় থাকেন তিনি। গত দশ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা তার মাথায় পানি দিচ্ছেন। সেলিম রেজার ভাড়া করা কক্ষটিতে থাকেন পরিবারের আট সদস্য। তার স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, প্রথমে আমরা কিছুই বুঝে ওঠতে পারিনি। কিন্তু গত তিন চারদিন আগে বাংলাদেশ মেডিকেলে ডেঙ্গু টেস্ট করিয়েছি। সেখানে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে আরো কয়েকদিন লাগবে ঠিক হতে।
পাশের বস্তি হান্নান মিয়ার বাড়ির বাসিন্দা দিনমজুর জলিল মিয়া (২২)। দুই সপ্তাহ ধরে জ্বরে আক্রান্ত। হাসপাতালে নেয়ার পরই ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। জলিল মিয়ার মা আম্বিয়া খাতুন বলেন, ডেঙ্গু যে কি ভয়ঙ্কর, আমার ছেলের না হলে বুঝতেই পারতাম না।
রায়ের বাজার বেড়িবাঁধের খোলা মাঠের কোনা এলাকায় রাজু, মাসুদ, নূর, হান্নান, শাহআলী, স্বপন, সরবত আলী, সেন্টু, মনির ডাক্তার, আলম মুহুরী, বশিরের বস্তিসহ প্রায় ১৫টি বস্তি ঘুরে দেখা যায় বেশির ভাগ পরিবারেরই কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত। এর মধ্যে অনেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। বেশিরভাগ বস্তিবাসীই জানে না ডেঙ্গু সম্পর্কে। তবে আতঙ্ক রয়েছে তাদের মধ্যে। অনেকে অভিযোগ করেছে ডেঙ্গু নিয়ে এখানে তেমন একটা সচেতনামূলক কার্যক্রম চালায়নি সংশ্লিষ্টরা। মশার ওষুধও ছিটানো হয়নি এখানে। সরবত আলীর বস্তির গ্যারেজ মেকানিক আলী হোসেন বলেন, আমি কখনো দেখিনি মশার ওষুধ দিতে। আমরা গরিব মানুষ, ক্ষমতা নেই। আমরা মরে গেলেও কারো কোনো ক্ষতি হবে না। এই জন্যই হয়তো ওষুধ ছিটায়নি।
অপরিষ্কার নোংরা, পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের নিয়েও আতঙ্ক কম নয় তাদের মধ্যে। সিদ্দিকী মিয়া বাড়ির বস্তির রিকশাচালক আলাউদ্দিন বলেন, জ্বর এই বস্তিতে সবারই হয় বা হচ্ছে। কিন্তু কোনটা জ্বর, কোনটা ডেঙ্গু আমরা বুঝবো কিভাবে। একই বস্তির লাবলি আক্তার বলেন, আমার স্বামীও গত কয়েকদিন আগে জ্বরে ভুগেছে। এখনো নাকি শরীর ব্যথা করে। ডাক্তার দেখাইনি। ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খাইয়েছি। এই বস্তির দায়িত্বে থাকা কুদ্দুস মিয়া জানান, দিনের বেলায় এই বস্তিতে ছোট ছোট অনেক মশা কামড় দেয়। সিটি কপোরেশনরে পক্ষ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানান তিনি।
এই রিপোর্টার প্রায় পনেরোটি ছোট ছোট বস্তি ঘুরে দশ-বারোজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর খোঁজ পেয়েছেন। জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এমন মানুষ পাওয়া গেছে অনেক। তবে তারা ঠিক জানেন না তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন কিনা। সেন্টু মিয়া বস্তির বাসিন্দা সোহেল মিয়া বলেন, আমার ভাই গত কয়েকদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। কিন্তু বলতে পারছি না ডেঙ্গু হয়েছে কিনা।