হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায় কখন হবে, সে প্রতীক্ষায় টেলিভিশনের সামনে বসেছিলেন সন্ত্রাসী হামলায় নিহত গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিমের বৃদ্ধ মা করিমন নেছা। ঘড়ির কাঁটা যখন বেলা সোয়া ১২টা তখন টিভির ব্রেকিং নিউজে ভেসে আসে হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। করিমন নেছা আলহামদুলিল্লা বলেই ছেলের ছবি বুকে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। বুধবার মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম এলাকায় নিহত রবিউল করিমের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্য।
এ মামলার রায়ের মধ্যদিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে ধারণ করা একবুক যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কমলো রবিউল করিমের পরিবারের। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাদের এখন দাবি দ্রুত রায় কার্যকর করার।
রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুবাদে সেখানেই অবস্থান করছেন। বাড়িতে রয়েছেন শুধু রবিউলের মা করিমন নেছা।
আর রবিউলের একমাত্র ছোট ভাই শামসুজ্জামান সামস কোর্টে চলে গেছেন রায় শোনার জন্য। মা করিমন নেছা সকাল থেকেই দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন টিভি পর্দায়। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কখনো চুমো খাচ্ছেন আবার আঁচল দিয়ে ছবিটি মুছছেন। সর্বক্ষণই পানিতে ছলছল করছে এই মায়ের চোখ। এ ছাড়া কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। ঘড়ির কাঁটা যখন ১২টা ১৫ মিনিট তখন টিভিতে ব্রেকিং নিউজে বলা হয়েছে ৭ জনের ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। এ সময় করিমুন নেছা আলহামদুলিল্লাহ বলে কেঁদে উঠেন। ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে সে কি কান্না। এ সময় সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও উপস্থিত সবাই হারিয়ে ফেলে।
করিমুন নেছা বলেন, আমি তো আর আমার সন্তানকে ফিরে পাবো না। তাই দীর্ঘ তিনটি বছর আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এই দিনটির জন্য। আজকে যে রায় হলো এতে আমি সন্তুষ্ট। আমি রায় দ্রুত কার্যকর চাই। রবিউল ছিল আমার একমাত্র মাথার ছায়া। তাকে হত্যা করার পর আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনকে আমি অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। কারণ আমাদের কঠিন এই বিপদে তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার বউমাকে একটি চাকরি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমি আমার দুই সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। দেশের জন্য জীবন দিয়ে রবিউল তার প্রমাণ রেখে গেছেন। সে সব সময়ই গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে ভালোবাসতো। তার স্বপ্ন ছিল একটি প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, সেটাও করে গেছেন। দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণার মাঝেও আমি একজন শহীদের মা হিসেবেই বেঁচে থাকতে চাই।
রবিউল ইসলামের স্ত্রী উম্মে সালমা রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম সেই রায় দিয়েছে মহামান্য আদালত। আমরা প্রত্যাশা করবো এই রায় যেন বহাল থাকে এবং খুব দ্রুত যেন এটি বাস্তবায়ন ও কার্যকর হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এই কর্মকর্তা বলেন, অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতে আইনের ফাঁক গলে যেন কোন অপরাধী পার পেয়ে না যায়। মামলার দ্রুত নিস্পত্তি করে অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত রবিউলের ভাই শামসুজ্জামান শামস। রায় ঘোষণার আগেই তিনি আদালতে উপস্থিত হন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই মামলাটি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে রায় দেয়া হয়েছে। হলি আর্টিজান হামলা মামলার মতো দেশের সকল আলোচিত মামলাগুলোর রায় দ্রুততার সঙ্গে দিলে, আমরা যারা স্বজন হারিয়েছি তাদের পরিবার কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। আদালতের প্রতি আমাদের যে আস্থা ছিল সেটা আরো বহুগুনে বেড়ে গেল। আইনগত কোনো ঘাটতির কারণে কোনো অপরাধী যেন শাস্তির আওতা থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আবারও পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন এটাই প্রত্যাশা।
শামস বলেন, আমার ভাই দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় হলি আর্টিজানে নিহত হয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি যেমন মানুষের জন্য কাজ করেছেন, ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরও তার স্বপ্নের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত স্কুল ‘ব্লুমস’-এর কার্যক্রম থমকে যাবে। ভেঙে যাবে রবিউলের স্বপ্ন। কিন্তু আমাদের পরিবারের সদস্যদের চেষ্টা ও মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় ভালোভাবেই পরিচালিত হচ্ছে স্কুলটি। আলো ছড়াচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুদের মাঝে। তিনি জানান, ২০১১ সালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাটিগ্রামে মায়ের দেয়া ২৯ শতাংশ জমির ওপর ১২ জন প্রতিবন্ধী শিশু নিয়ে স্কুলটির যাত্রা শুরু করেন রবিউল। স্কুলটির পুরো নাম বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড এন্ড সোসাইটি। টিনের ঘর থেকে এখন পরিণত হয়েছে তিন কক্ষবিশিষ্ট ৬০ ফুট লম্বা পাকা দালানে। বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২। পাঠদানের পাশাপাশি স্কুল আঙিনায় তৈরি করা হয়েছে শিশুদের বিনোদনের দোলনাসহ কয়েকটি রাইডস। ভাই আজ বেঁচে থাকলে কি যে খুশি হতেন, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।