ব্যান্ডেজে মোড়া দুই হাত। বাঁ চোখের পাশেও গভীর ক্ষত। গুরুতর জখম বুকেও। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তিনি ২০১০ সালের স্কুলভিত্তিক প্রতিভা যাচাই প্রতিযোগিতা ‘মার্কস অলরাউন্ডার’ চ্যাম্পিয়ন সাদিয়া রহমান বিপা (২০)।
স্বামীর নৃশংসতার শিকার সাদিয়া বর্তমানে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) জীবনের সঙ্গে লড়াই করছেন। পরিবারের অভিযোগ, প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কারণে পাওয়া ১০ লাখ টাকা না দেওয়ায় স্বামীর এমন নির্মমতা।
এ ঘটনায় সাদিয়ার মা জোছনা রহমান বাদী হয়ে স্বামী সরোয়ারসহ আরও তিনজনের নামে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা করেছেন। পুলিশ সরোয়ারকে গ্রেপ্তার
করে কারাগারে পাঠিয়েছে। কিন্তু ঘটনার পর স্বামীর পরিবারের নিরন্তর হুমকি-ধমকি ও বাকি আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের উদাসীনতায় আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সাদিয়ার পরিবার।
২০১২ সালে মতিঝিল মডেল স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান সাদিয়া। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। ‘মার্কস অলরাউন্ডার’ প্রতিযোগিতায় সাফল্য ছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। অংশ নিয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও।
রাজধানীর দক্ষিণ শাহজাহানপুরে পরিবারের সঙ্গেই থাকেন সাদিয়া। দুই বছর আগে বরিশালের কোতোয়ালি থানার প্রাইমারি স্কুল সড়ক এলাকার বাসিন্দা দক্ষিণ কোরিয়াপ্রবাসী সরোয়ার হোসেন ওরফে মাসুদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর এক মাস স্বামীর সঙ্গেই বরিশালে ছিলেন। এক মাস পর স্বামী দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যান। লেখাপড়ার জন্য সাদিয়া চলে আসেন ঢাকায়।
সাদিয়ার পরিবার জানায়, বিয়ের পাঁচ-ছয় মাস পর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফোন করে সাদিয়ার কাছে ‘মার্কস অলরাউন্ডার’ প্রতিযোগিতা থেকে পাওয়া ১০ লাখ টাকা দাবি করেন সরোয়ার। কিন্তু তা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় সরোয়ার নানাভাবে হুমকি দেন। ২২ জুলাই হঠাৎ দেশে ফিরে সরোয়ার সোজা চলে যান সাদিয়ার বাসায়। ওই বাসায় ২৩ জুলাই রাতে চালানো হয় হামলা।
গতকাল দুপুরে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ব্যান্ডেজে মোড়া দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন সাদিয়া। তাঁকে দেখতে এসেছেন স্বজন এবং পরিচিত সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা। মেয়ের ওপর নির্যাতনের কথা বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠছেন জোছনা রহমান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জোছনা রহমান বলেন, ‘সরোয়ার ছাড়াও বরিশাল থেকে তাঁর মা দুলু বেগম, বড় ভাই মো. খোকন ও ছোট ভাই মো. বাপ্পী আমাদের বাসায় আসেন। তাঁরা আমার মেয়েকে বরিশালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আগে হুমকি দেওয়ায় আমার মেয়ে ভয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না। একপর্যায়ে সরোয়ার বাসায় থেকে যান। বাকিরা চলে যান বরিশালে।’
জোছনা আরও জানান, ‘২৩ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে সরোয়ারের ভাই খোকন আমাকে ফোন করে ১০ লাখ টাকা দিয়ে সরোয়ারের সঙ্গে সাদিয়াকে পাঠিয়ে দিতে বলেন। ওই ফোনেই সরোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চান তাঁর মা দুলু। ফোনটা নিয়েই ছুড়ে মেরে ভেঙে ফেলেন সরোয়ার। উত্তেজিত হয়ে আমাকে বের করে দিয়ে বাসা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেন। আমি চিৎকার করে জানালা দিয়ে দেখি, আমার মেয়েকে ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করছে সরোয়ার।’
ঘটনার পর দরজা খুলে পালানোর চেষ্টা করেন সরোয়ার। কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বাসার নিরাপত্তাকর্মী ও প্রতিবেশীরা সরোয়ারকে ধরে ফেলেন। খবর দেওয়া হলে পুলিশ সরোয়ারকে আটক করে। পুলিশ একটি রক্তমাখা ছুরিও উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সরোয়ারের মা দুলু বেগম এবং দুই ভাই খোকন ও বাপ্পীর নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করা হয়। অন্যদিকে রক্তাক্ত অবস্থায় সাদিয়াকে উদ্ধার করে প্রথম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখান থেকে পাঠানো হয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। সেখানে প্রাথমিক অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকেরা হাতের হাড়ের আঘাতের চিকিৎসার জন্য পাঠান পঙ্গু হাসপাতালে। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা পরিবারকে জানিয়েছেন, রগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাদিয়ার ডান হাতের তিনটি আঙুল অকেজো হয়ে যেতে পারে।
হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসাপত্রে সাদিয়ার ডান হাতের নালি, রগ, মাংস ও হাড়ে গুরুতর জখমের কথা লেখা আছে। মামলার কাগজপত্রে দেখা গেছে, লিখিত অভিযোগে সরোয়ার ছাড়াও তাঁর মা দুলু ও দুই ভাইয়ের নাম লেখা হয়েছে। কিন্তু মামলার প্রাথমিক বিবরণীতে থাকা আসামির ছকে শুধু সরোয়ারের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহজাহানপুর থানার এসআই গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, ঘটনার সময় বাকি তিনজন ছিলেন না। তাই তাঁরা আসামি নন।
সাদিয়ার পরিবার জানায়, পুলিশের এ উদাসীনতার কারণে সরোয়ারের পরিবার এখন মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। না হলে বরিশালে থাকা সাদিয়ার আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে সরোয়ারের ভাই খোকন বলেন, ‘এটা মিথ্যা অভিযোগ। সাদিয়া নিজেই নিজের হাতে পোঁচ দিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে চাচ্ছে।’ চোখের পাশে কীভাবে জখম লাগল—প্রশ্ন করলে খোকন বলেন, ‘সরোয়ারের সঙ্গে হাতাহাতিতে চোখের পাশে লাগছে।’ নিজে নিজে হাত কাটলে হাতাহাতি হয় কীভাবে? প্রশ্ন করলে খোকন এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, ‘সরোয়ার ও তার পরিবার আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি সরকারের কাছে সুষ্ঠু বিচার চাই।’