অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের নাটকীয়তা দেশীয় সংগীতাঙ্গনের জন্য নতুন কোন বিষয় নয়। সিনিয়র শিল্পী-প্রযোজকদের এমন অবস্থানের পরও নব্বই দশক থেকেই অডিও ইন্ডাস্ট্রি একটি বড় শিল্পে রূপ নেয়। কারণ, তখন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগগুলো ছিল সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরে যখন পাইরেসি এবং ইন্টারনেটে ফ্রি ডাউনলোডের কবলে অডিও ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের পথে, ঠিক সে সময় সিনিয়র শিল্পীদের সঙ্গে অডিও প্রযোজকদের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। সত্যিই এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। দেনা পাওনা বিষয়ে অডিও কোম্পানি সাউন্ডটেকের স্বত্বাধিকারী সুলতান মাহমুদ বাবুলের বিরুদ্ধে ব্যান্ড তারকা জেমসের করা মামলায় এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। অডিও প্রযোজকরা নিজ অর্থায়নে সিনিয়র শিল্পীদের গানের অ্যালবাম প্রকাশও প্রায় বন্ধ করে দেয় ‘তাদের গান চলে না’ এমন অজুহাতে। অন্যদিকে অনেক ব্যান্ড ও সিনিয়র শিল্পীকে দেখা গেছে মোবাইল ফোন কোম্পানিতে নিজেদের অ্যালবাম ডিজিটালি প্রকাশ করতে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও এই ধারার মাধ্যমে গান প্রকাশ করে সফলতা পাওয়ার উদাহরণ খুব কম। এদিকে ব্যান্ড সংগীত সংগঠন বামবা এবং সিনিয়র শিল্পীদের সংগঠন এলসিএস গিল্ড নিজেদের গানের ন্যায্য পাওনা হাসিলে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলন এবং আলোচনা সভায় নানারকম পরিকল্পনার কথা বলে এলেও সেগুলো বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বরং বিভিন্ন দ্বন্দ্ব দেখা যায় দুটি সংগঠনের কর্তাব্যক্তি ও সদস্যদের মধ্যেও। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্টের কার্যক্রম নিয়ে গত বছর তোলপাড় শুরু হয়। এটি ছিল অডিও কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান, যারা কিনা পেন ড্রাইভ, মেমোরি কার্ডে গান প্রদানের বিষয়টিকে বৈধতা দান করে ব্যবসা করছিলো। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে সিনিয়র শিল্পীদের বিভিন্ন অভিযোগ উথাপিত হলে পরবর্তীতে এর অবস্থান সম্পর্কেও জানান ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্ট কর্তৃপক্ষ। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে মেমোরি কার্ড কিংবা পেনড্রাইভে গান প্রদানের বিষয়টি বৈধতা দান করলে শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, অডিও প্রযোজক তথা পুরো অডিও ইন্ডস্ট্রির উন্নতি হবে বলেও যুক্তি দাঁড় করায় তারা। তবে এর বিরুদ্ধে সংগীত সংগঠন ও সিনিয়র শিল্পীদের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে এখন বন্ধ রয়েছে ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্টের কার্যক্রম। এদিকে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এখন দ্বিমুখী নয়, ত্রিমুখী অবস্থান বিরাজ করছে অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে। সিনিয়র শিল্পী, অডিও প্রযোজক এবং চলতি প্রজন্মের তরুণ শিল্পীরা। সিনিয়র শিল্পীরা বিপরীতে অবস্থান নিলেও চলতি প্রজন্মের অনেক শিল্পীই ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্টের কার্যক্রমকে সাধুবাদও জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে বামবার বিপরীতে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে চলতি প্রজন্মের ব্যান্ডগুলো নিয়ে নতুন সংগঠন এসএমবি, যা কিনা আবারও পরিষ্কার করলো সিনিয়রদের সঙ্গে চলতি প্রজন্মের শিল্পী ও ব্যান্ডের মতবিরোধের বিষয়টি। একদিকে সিনিয়রদের দিকনির্দেশনার অভাব এবং অন্যদিকে অডিও কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা করার মনোভাবে অনেকটা কোণঠাসা এখন চলতি প্রজন্মের শিল্পীরা। এমনিভাবে একতার অভাবে বর্তমানে ত্রিমুখী অবস্থানে রয়েছে অডিও অঙ্গন। অথচ সিনিয়র, জুনিয়র ও অডিও প্রযোজকদের একতাই পারে অডিও অঙ্গনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে। এ বিষয়ে প্রখ্যাত সুরকার ও ব্যান্ড তারকা নকীব খান বলেন, বর্তমানে সংগীতাঙ্গনে ভাগ চলছে এটা ঠিক। যে যার মতো করে কাজ করছে। কোন একতা নেই। এটা খুবই দুঃখজনক ও লজ্জার ব্যাপার। এই একতা যতদিন না আসবে পুরো মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়ন সম্ভব নয়। একই সুরে অডিও শীর্স প্রযোজকরা বলেন, আমরা বহুবার চেয়েছি এক ছাদের নিচে শিল্পী, সুরকার-গীতিকারদের নিয়ে বসতে। কিন্তু সেটা পারিনি। কারণ একটাই, একতা নেই। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চান না। না হয় অডিও ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি অনেক আগেই সম্ভব ছিল। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো অডিও ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে, উৎকর্ষে সরকারের নীরব ভূমিকার বিষয়টি। ফ্রি ডাউনলোডের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবহিত থাকলেও সেক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না তাদের। অন্যদিকে শিল্পী ও অডিও কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে একটি আলোচনা সভাই পাল্টে দিতে পারে অডিও ইন্ডাস্ট্রির রূপ। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং আমাদের সিনিয়র শিল্পী-প্রযোজকদের অবস্থান নিয়ে। সমপ্রতি একটি অনুষ্ঠানে সংগীতশিল্পী ও গানবাংলা টেলিভিশনের চেয়ারম্যান তাপস উপস্থিত অনেক সিনিয়র শিল্পীকে আহ্বান জানান একাত্মতার। তিনি বলেন, গীতিকার, শিল্পী, সুরকার, অডিও কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ গানবাংলা টিভির অফিসে। সেখানে একসঙ্গে বসে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। নিশ্চয়ই আমরা এক হয়ে সরকারের কাছে আবেদন করলে পাইরেসি-ফ্রি ডাউনলোড বন্ধ সম্ভব হবে। এটা আমার বিশ্বাস। এ সময় উপস্থিত সবাই তাপসের এই আহ্বানকে স্বাগত জানান। কিন্তু আসলেই শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বাস্তবায়ন হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।