হৃদরোগী এবং আমাদের হৃদরোগ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকিৎসার সময় চিকিৎসকরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হন। অনেক রোগীর মনে রোগ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন এমনকি অমূলক ভয় বা আতংক দেখা দেয়।
মাদের বুকের ভেতর অবস্থিত হৃদযন্ত্রটি একটি পাম্প মেশিনের মতো সার্বক্ষণিকভাবে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে যাচ্ছে। করোনারী অ্যার্টারীর মাধ্যমে এই হৃদযন্ত্রের মাংসপেশীতে পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ হয়। করোনারী অ্যার্টারীর মধ্যে চর্বি জমে গেলে (অ্যাথেরোসক্লেরোসিস) রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে অ্যানজিনা পেকটোরিস ও হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এই রোগের আসল কারণ সম্যক জানা না গেলেও নিয়ামক কারণ জানা গেছে।শিল্প বিপ্লব আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কঠোর পরিশ্রম থেকে রেহাইও পেয়েছি। সেখানেই গোলমাল! যন্ত্রচালিত জীবন আরাম-আয়েশ স্ট্যাটাস সব দিয়েছে; কেড়ে নিয়েছে সুস্থ জীবন। না খাটুনির কুফল পায়ে পায়ে জড়িয়ে গেছে। এর প্রথম ও প্রধান সমস্যা হয় হার্টে। হার্ট সমস্যা পৃথিবীর বৃহত্তম সমস্যা হিসেবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মত প্রকাশ করেছে। হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে।বুকে ব্যথা না থাকলেও হার্টের অসুখ থাকতে পারে। এ ছাড়া হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক রুখতে নিয়মিত চেকআপ করা দরকার।উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়মিত নিয়ন্ত্রিত রাখা (সপ্তাহে ১ দিন রক্তচাপ পরীক্ষা, মাসে ১ বার রক্তের সুগার দেখা, ৩ মাস পরপর লিপিড প্রফাইল ও ৬ মাস পর পর ইসিজি ও বছরে ১ বার করে ইটিটি করা উচিত- নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার পরও)।রক্তের পরীক্ষালিপিডস (Cholsterol, HDL, LDL & TG) যাদের রক্তে Cholsterol, HDL, LDL & TG-এর পরিমাণ বেশি থাকে তাদের হৃদরোগের আশংকা বেশি। অভুক্ত অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করলে সঠিক পরিমাণ জানা যায়।রক্তে সুগার বা গ্লুকোজ : সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে এবং এদের বুকে ব্যথা ছাড়া হার্টের অ্যাটাক হয়ে থাকে। তাই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা তা এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়।অন্যান্য পরীক্ষাইসিজি (ECG) : হার্ট ও ইসিজি শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হার্টের কোনোরকম সমস্যা আছে সন্দেহ হলে চিকিৎসক প্রথমে ইসিজি করতে বলেন। ইসিজি থেকে হার্টের রেট, রিদিম, রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া, মায়োকার্ডিয়াম ইত্যাদি বিষয়ে জানা যায়। যদিও পরীক্ষা থেকে ১০০% নিশ্চিত হওয়া যায় না এবং আরও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। ইসিজি পরীক্ষার জন্য পূর্ব প্রস্তুতির দরকার হয় না। তুলনামূলক অল্প সময়ে কম খরচে ইসিজি করা যায়।হল্টার মনিটর (Holter Monitor) : হার্টের কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা একই রকম আছে কিনা এ বিষয়ে জানার জন্য হল্টার পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বুকে ছোট একটা মেশিন লাগিয়ে হার্টের ২৪ ঘণ্টার ইসিজি রেকর্ড করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে হঠাৎ হার্টের কার্যক্রম বিঘ্ন ঘটলে এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়। এই পরীক্ষা করতে কোনো ধরনের প্রস্তুতির দরকার হয় না।ইটিটি (ETT) বা এসটিটি (STT) : পরিশ্রমের ফলে হার্টের রেট, রক্তে চাপ বেড়ে যায় এবং হার্টে রক্ত জোগান বেশি দরকার হয়। হার্ট এই বাড়তি প্রয়োজন সামলাতে পারছে কিনা তা বোঝা যায়। অনেক সময় বাড়তি চাপ সহ্য করতে না পারলে পরীক্ষার সময় হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, তাই একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে ইটিটি করার নিয়ম। এই পরীক্ষা ইসিজি থেকে একটু বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে।ইকো কার্ডিওগ্রাফি (Echocardiography) : আল্ট্রা সাউন্ড (Ultra Sound) পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে হার্টের ছবি, হার্টের আকৃতি, পরিমাণ, ভেতরে অবস্থিত কক্ষ, ভাল্ব, রক্ত সঞ্চালনের গতি, হার্টের আবরণ ও বিভিন্ন গঠন বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। এই পরীক্ষা করাতে রোগীর যেমন প্রস্তুতি এবং কাটা-ছেড়ার দরকার হয় না। এই পরীক্ষার মাধ্যমে অল্প সময়ে হার্টের যাবতীয় বিষয়ে জানা সম্ভব হয়।মাল্টি স্লাইস সিটি স্ক্যান (Multi Slice CT scan) : এটা হার্টের অসুখ নির্ণয়ে সর্বাধুনিক নিরাপদ ও দ্রুততম পরীক্ষা। মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময়ে কার্ডিওভাসকুলার রোগ নির্ণয় সম্ভব। এই পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের রক্তবাহী ধমনির পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। বাইপাস সার্জারি, এনজিওপ্লাস্টি করার আগে ও পরে এই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় কোনো ধরনের অপারেশনের দরকার পড়ে না এবং হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। এনজিওগ্রামের পরিবর্তে এই পরীক্ষা অনেক অল্প সময়ে ও নিরাপদে করা সম্ভব।বুকের এক্স-রে : বুকের এক্স-রের মাধ্যমে হার্টের আকার, অবস্থান, ভালভুলার ডিজিজ সম্পর্কে জানা যায়।কার্ডিয়াক ক্যাথেটার ও এনজিওকার্ডিওগ্রাফি : একটি আধুনিক প্রযুক্তি যার মাধ্যমে রোগীর ধমনি বা শিরার ভিতর দিয়ে সরু ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে হার্ট থেকে রক্ত এনে পরীক্ষা করা হয় এবং হার্টের বিভিন্ন চেম্বার, শিরা ও ধমনির প্রেশার নিরূপণ করা হয়। এ ছাড়া এক ধরনের তরল ওষুধ হার্টের চেম্বার ও ধমনিতে ইনজেকশন দিয়ে বিশেষ ধরনের এক্স-রে করা হয় এবং হার্টের বিভিন্ন জটিল রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এ পরীক্ষায় রোগীকে অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না।করোনারী এনজিওগ্রাফি : এটি বিশেষ উন্নতমানের পরীক্ষা যার মাধ্যমে করোনারী হৃদরোগ বা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ অতি সহজেই নিরূপণ করা যায় এবং চিকিৎসার দিক নির্দেশনা দেয়া যায়। করোনারী আর্টারী কতটুকু সরু হয়েছে এবং কোন কোন জায়গায় সরু হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে রোগীকে কি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা সম্ভব, বেলুন দিয়ে প্রসারিত করা যাবে অথবা বাইপাস অপারেশন লাগবে সে ব্যাপারে মতামত দেয়া যায়।