বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র কি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে? ২০১৪ জুড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিকদের মধ্যে নানা বিতর্কে বারবার এই প্রশ্নটিই ঘুরেফিরে এসেছে। বছরের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট এক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে মন্তব্য করে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা রয়েছে গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র যেসব সমস্যায় পীড়িত সেগুলোর মধ্যেই। বিংশ শতাব্দীতে গণতন্ত্রের চমকপ্রদ বিকাশ ঘটেছিল যে কারণে তার পেছনে কারণ ছিল আমেরিকার আধিপত্য বা প্রভাববলয়ের বিস্তৃতি। কেননা, স্বাভাবিকভাবেই অন্য দেশগুলো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশকে অনুকরণ বা অনুসরণের চেষ্টা করেছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে চীনের প্রভাব বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের আদর্শ বা মডেল হিসেবে আমেরিকা এবং ইউরোপের প্রতি বাকি বিশ্বের আগ্রহ কমতে শুরু করেছে। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে গণতন্ত্রের মাধ্যমে জিহাদি বা ইসলামি উগ্রবাদীদের উত্থানের আশঙ্কা, যে দুর্ভাবনায় ওবামা প্রশাসনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। (হোয়াটস গন রং উইথ ডেমোক্রেসি, দি ইকোনমিস্ট, ১ মার্চ, ২০১৪)। গাজায় হামাস কিংবা মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচনী সাফল্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে কতটা বিব্রতকর অবস্থার মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তা নিশ্চয়ই কেউ বিস্মৃত হননি।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রসার ও তার বিকাশে সহায়তা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ঘাটতিতে অনেকেই উৎকণ্ঠিত। এদেরই একজন কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস–এর ভাইস প্রেসিডেন্ট থমাস ক্যারোর্থাস লিখেছেন বারাক ওবামা প্রশাসনের আমলে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রসারে সহায়তা ক্রমেই কমেছে (হোয়াই ইজ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস শর্টচেঞ্জিং ইটস কমিটমেন্ট টু ডেমোক্রেসি; ওয়াশিংটন পোস্ট, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪)। তিনি বলছেন, ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র প্রসারের লক্ষ্যে ইউএসএইডের যে কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল তাতে বরাদ্দ ২০০৯ সালের পর থেকে কমেছে ৩৮ শতাংশ। বিশ্বের সব অঞ্চলেই তাদের এই কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। এমনকি যেখানে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের হাওয়ায় গণতন্ত্রায়ণের ঐতিহাসিক ধারা সূচিত হয়েছিল, সেখানেও বরাদ্দ কমেছে ৭২ শতাংশ। থমাস ক্যারোর্থাস হিসাব উদ্ধৃত করে বলছেন যে ইরাক, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানকে বাদ দিলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন খাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাহায্যের পরিমাণ ৮৬ কোটি ডলার, যা জর্জ সরোসের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের একই খাতে বরাদ্দের চেয়েও কম। তিনি তাই প্রশ্ন করেছেন যে গণতন্ত্র প্রসারে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার তার একজন নাগরিকের একক উদ্যোগের সমান না হওয়ার পরও কী করে দেশটি নিজেদের বিশ্বে গণতন্ত্রের অতুলনীয় শক্তি হিসেবে দাবি করে। গণতন্ত্র প্রসারে সহায়তা কমার কারণ যে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক বৈদেশিক সহায়তা বাজেট সংকোচনের কারণে ঘটছে, তা তিনি মনে করেন না। বরং তাঁর ধারণা, প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্রনীতি গণতন্ত্র প্রসারের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। তাদের ভাবনায় আগে রয়েছে স্থিতিশীলতা, পরে গণতন্ত্র। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংঘাতের বিস্তৃতি সামাল দিতে হিমশিম খাওয়া প্রশাসনের কাছে স্থিতিশীলতার গুরুত্বই বেশি। এটিকে তিনি যে শুধু ভুল বলে মনে করেন তাই নয়, তাঁর মতে তা বিপজ্জনকও বটে।
দি ইকোনমিস্ট-এর নিবন্ধে অবশ্য বলা হয়েছে, সাম্প্রতিককালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এত বেশি সংখ্যায় ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাচনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে গণতন্ত্রের অন্য আবশ্যিক উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত করা, ব্যক্তির অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে কম। নিবন্ধে আফ্রিকার দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা প্রকট হওয়ার পাশাপাশি থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং বাংলাদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার সংকটের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয় যে নব্য-গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে তারাই সফল হয়েছে বেশি যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকে রাজনীতিকেরা নিবৃত্ত থেকেছেন; নির্বাচন মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দল যা খুশি তাই করতে পারবে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত এবং ১৯৮০ সালের পর থেকে ব্রাজিল যে গণতন্ত্রের ধারা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে তার কারণ, পত্রিকাটির মতে, সরকারের কর্তৃত্ব বা ক্ষমতাকে সীমিত রাখা এবং ব্যক্তির অধিকারকে নিশ্চিত করা।
দি ইকোনমিস্ট-এর আরও একটি চমকপ্রদ বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে উদীয়মান অর্থনীতি বা দেশগুলোতে রাজনৈতিক কাঠামোগুলো বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে এবং তাদের অগণতান্ত্রিক স্বভাবের কারণে রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব খাটো হচ্ছে। এ রকম স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর একটি দৃষ্টান্ত এসেছে ভারত থেকে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে সেখানকার সংসদের নিম্নকক্ষ, লোকসভার সদস্যদের মধ্যে ৩০ বছরের কম বয়সী যাঁরা, তাঁরা সবাই এমপি হয়েছেন পারিবারিক উত্তরাধিকারের ধারায়। (বাংলাদেশের সংসদ এবং রাজনীতিতেও এখন এই বংশগত ধারা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হতে চলেছে।)
ওই বিতর্কের ধারাবাহিকতায় ২৭ মার্চ গ্রোথ: অটোক্রেসি অর ডেমোক্রেসি শিরোনোমের আরেকটি নিবন্ধে পত্রিকাটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো যোগসূত্র আছে কি না বা থাকলে সেটা কী ধরনের, তার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। বিশ্লেষণে বলা হয় যে ১৯৫০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে পূর্ব এশিয়ায় প্রকৃত আয় বেড়েছে সাত গুণ। ওই একই সময়ে সেখানে গণতন্ত্রও বিকশিত হয়েছে। একদল অর্থনীতিবিদ বলেছেন যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের কারণে ওই সব দেশকে গণতন্ত্রায়ণের পথে যেতে হয়েছে, গণতন্ত্রের কারণে সমৃদ্ধি এসেছে এমনটি নয়। এশিয়ার সবচেয়ে সফল অর্থনীতিগুলো একধরনের ত্রুটিযুক্ত গণতন্ত্র অথবা গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদমিশ্রিত হাইব্রিড পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় চলছে উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়, এদের অধিকাংশ অবশ্য গণতন্ত্রের পথেই রয়েছে, গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে যায়নি।
আগে উন্নয়ন, নাকি গণতন্ত্র? এই প্রশ্নটিকে ঘিরে বিতর্ক বাংলাদেশেও খুবই প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি ঢাকাতেও এক সভায় বিষয়টির ওপর আলোচনা শুনেছি। আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বদানকারী প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই অর্থনীতিবিদের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের সময় গত ১২ নভেম্বর প্রথম আলো আয়োজিত তরুণ শিক্ষক-গবেষকদের এক মতবিনিময় সভার প্রথম প্রশ্নই ছিল এটি। অধ্যাপক ইসলাম জানান যে যতবারই তিনি দেশে আসেন ততবারই আগের চেয়ে একটু বেশি হতাশ হন। কারণ, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বিতর্ক চলে তা চলে গুরুত্বহীন বিষয়কে ঘিরে। দেশটি কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেই (অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক) আকাঙ্ক্ষার কথা এখনো অনেকেই জানেন না। তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তরুণদের প্রতি শেখার জন্য ঘাম ঝরানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন যে এটি ছাড়া পরিবর্তন আসবে না। তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা এবং তাদের ঘাটতিগুলো পূরণে সামাজিক উদ্যোগ বা সুশীল সমাজের ভূমিকার কথা উঠে আসে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাও যে কতটা জরুরি, গণতন্ত্রের তীর্থভূমি ইংল্যান্ডের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি তা ব্যাখ্যা করেন। গণতন্ত্র এবং প্রবৃদ্ধির বিতর্কেও তিনি সবাইকে উৎসাহ দেন। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই বিতর্কের সুযোগ কত দিন পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসনের আমলে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সামাজিক স্থিতিশীলতার যে দোহাই শোনা যেত, বেশ কিছু দিন ধরে আবার সেই ধুয়োই শোনা যাচ্ছে। জিয়া ও এরশাদ উভয়েরই স্লোগান ছিল উন্নয়নের রাজনীতি। এবারও যাঁরা এই তত্ত্বের প্রচারণায় মেতেছেন তাঁরা ২০৪১-এর আগেই বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তাঁরা এমনই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান যে তাঁদের দাবি, সবকিছু তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের সারিতে উন্নীত হবে। তাঁদের পরিকল্পনায় অন্তত ২০১৯ পর্যন্ত দেশে কোনো কার্যকর বিরোধী দলের স্থান নেই। এর আগে উন্নয়নের মডেল হিসেবে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের কথা বলা হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বলেছেন চীনের উন্নয়ন মডেল অনুসরণের কথা। হাইব্রিড গণতন্ত্রে ভিন্নমতের প্রতি যতটা সহনশীলতা থাকা দরকার তিনি এখন সম্ভবত সেটুকুও আর ধরে রাখার প্রয়োজন দেখছেন না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচনে রাষ্ট্র এবং তার প্রায় প্রতিটি অঙ্গই এখন সক্রিয়। উন্নয়নের চৈনিক মডেলে অবশ্য ভিন্নমত দমনই রীতি। পত্রিকা অফিসে পুলিশ পাঠিয়ে তল্লাশি চালানোর চেষ্টা এবং সাংবাদিকদের ভিডিওচিত্র ধারণকে ভীতি প্রদর্শনের ইঙ্গিত ছাড়া আর কী–ই বা বলা চলে?
শুধু গণতন্ত্রেই অর্থনৈতিক প্রগতি সম্ভব এমন ধারণা ভেঙে দিয়েছে যে চীন। হার্ভার্ডের অর্থনীতিবিদ ল্যারি সার্মাস দেখিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধির হার যখন সবচেয়ে বেশি ছিল তখন সেখানে জীবনযাত্রার মান দ্বিগুণ উন্নত হতে সময় লেগেছে গড়ে ৩০ বছর, কিন্তু চীনে জীবনযাত্রার মান দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে প্রায় প্রতি দশকে। চীনের অগ্রযাত্রার একটি বড় কারণ হচ্ছে তাদের উদ্ভাবনীশক্তি বা সৃজনশীলতা। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংস্থা- ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত তার সর্বসাম্প্রতিক জরিপে বলেছে যে বৈশ্বিক উদ্ভাবনের শীর্ষে রয়েছে চীন। পেটেন্ট এবং কপিরাইটের জন্য জমা পড়া আবেদনের ভিত্তিতে সংস্থাটি বলছে যে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে চীনের পর দ্বিতীয় অবস্থানটি ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের এই নাটকীয় সাফল্যের অন্যতম কারণ সম্পর্কে দি ইকোনমিস্ট বলছে যে দেশটিতে কমিউনিস্ট পার্টির যেমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে তেমনি দলটির মধ্যে একটি নিরন্তর চেষ্টা আছে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার। এর প্রমাণ মেলে প্রতি দশকে দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনে। লক্ষ্য অর্জনের সামর্থ্য ও দক্ষতার ভিত্তিতে পার্টি ক্যাডারদের মধ্যে উচ্চতর দায়িত্বে পদোন্নতি দলে তরতাজা মেধা ও প্রাণশক্তি সঞ্চার করছে। বিপরীতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে (এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী গোষ্ঠীগুলোসহ) মেধার যেমন কোনো স্থান নেই তেমনি নেতৃত্বও হচ্ছে ব্যক্তির আমৃত্যু তালুকদারি। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের ধারা।
post by Usman gony