আরিফ উদ্দিন, গাইবান্ধা প্রতিনিধি: ক্ষমতার লড়াইয়ের বলি হয়ে আমার মত এভাবে আর কত মায়ের কোল খালি হবে বলে বুক চাপড়াচ্ছেন পুত্র শোকে শোকাহত স্নেহময়ী গর্ভধারিনী মাতা মাজেদা বেগম ও অসহায় পিতা লাল মিয়া। অকালে চলে যাওয়া পুত্র পুলিশ কনস্টেবল শামীমের (কংনং-৩৬৬৬) জন্য। দেশে বিরাজমান রাজনীতিক টাল-মাটাল অবস্থার জন্যই আজ আমার ছেলেকে হারাতে হলো। ২ মাসের অন্তঃসত্ত্বা শামীমের স্ত্রী কিলকিস বেগম স্বামীর অকাল মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে তার গর্ভে শামীমের অনাগত সন্তানের কি হবে শোকে নানা বিলাপ করছেন। প্রতিটি মূহুর্তে-মূহুর্তেই নানা বিলাপ করে মূর্ছা যাচ্ছেন বাবা-মা, স্ত্রী ও আত্মীয়- স্বজনরা। সবার চোখ দিয়ে ঝরঝরে ঝরছিল অশ্রু। এ পৃথিবী ছেড়ে শামীম এখন দুরে-বহুদুরে। শামীমের স্বজনদের প্রশ্ন আর কত লাশ হলে দেশে শান্তি আসবে-বলতে পারেন কেউ? মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পুলিশ কনস্টেবল শামীমের অনুপুস্থিতিতে স্ত্রী কিলকিসের ভাবনা আমাদের সব ভবিষ্যৎ গুলো যেন অংকুরেই বিনষ্ট হলো। গত ১৭ জানুয়ারি পেটেধাল বোমায় দগ্ধ হওয়ার কয়েক মিনিট আগেও শামীম তার মোবাইলে মা-বাবাকে বলেছিলেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু অনুকূলে এলেই আমি বাড়ি আসছি। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কিলকিসকে বলেছেন ‘ওগো’ আমার অনাগত সন্তানের মা তুমি। ছুটি পেলেই আসছি আমি। কিন্তু সেই এলেন। প্রাণ নিয়ে নয়। নি ̄প্রাণ হয়ে। শুক্রবার শামীমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এ গগন বিদারি স্বজনদের আহাজারি আর্তনাদ। গোটা গ্রাম শোকে আচ্ছন্ন। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মিরপুর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম নামাজে জানাজা শেষে পুলিশের একটি এ্যাম্বুলেন্স যোগে শুক্রবার ভোর রাতে শামীমের লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে। এ সময় পুরো গ্রামে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। শোকাহত পরিবেশে শেষ বারের মত শামীমকে এক নজর দেখতে গোটা গ্রামবাসির ভীড় বেড়ে যায়। সকলের প্রশ্ন এ নৃশংস হত্যার দায়ভার বহন করবে কে? বাবা-মার প্রশ্ন আর যেন কেউ পুত্র হারা না হয়, স্ত্রীর প্রশ্ন আর যেন কেউ স্বামী হারা এবং বোনের প্রশ্ন আর যেন কেউ ভাই হারা না হয়। পরিবারের সদস্যরা জানান, চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে শামীম তৃতীয়। তিনবছর আগে গাইবান্ধা সদর উপজেলার সাহাপাড়া ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য বাদশা মিয়ার মেয়ে বিলকিস আক্তারকে বিয়ে করেন শামীম। শামীমের বড় ভাই সাজু মিয়া বিজিবিতে চাকুরী করতেন। বিডিআর বিদ্রোহের সময় তিনি চাকুরী হারিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। বড় বোন ফেন্সি বেগম বিয়ের পর থেকে স্বামীর বাড়িতে। ছোট ভাই রিজু সম্পধতি এইচএসসি পাশ করেছেন। আরেক ভাই শাহিন মানুষিক প্রতিবন্ধী। এছাড়া শামীমের অতি আদরের ছোট বোন নাজমা আক্তার গাইবান্ধা সরকারী কলেজে অর্নাস তৃতীয়বর্ষের ছাত্রী। গত ৮ বছর আগে শামীম পুলিশে যোগদেন। ওই পরিবারের সকলেরই প্রিয় শামীমের চাকুরীর পর পরিবারটি কিছুটা স্বচ্ছলতার দিকে এগুচ্ছিল। দুর্বৃত্তেদের পেট্রোল বোমায় আগুনে পুড়ে মারা যান পুলিশ পুলিশ কনস্টেবল শামীম (২৮)। গত ১৭ জানুয়ারি হরতাল-অবরোধে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন শেষে রাত ৮টার দিকে পরিশ্রান্ত শামীম স্টাফ বাসযোগে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ফিরছিলেন। এসময় মৎস্য ভবন সংলগ্ন দুর্বৃত্তরা ওই বাসটিতে পেটেধাল বোমা নিক্ষেপ করে। এতে শামীমের শরীর পুড়ে যায় এবং মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান। স্কয়ার হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন শামীমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়। বিছানায় মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বৃহস্পতিবারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শামীম। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমেদপুর গ্রামে গতকাল শুক্রবার বাদ জুম্মা দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়। এ সময় পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম (পিপিএম সেবা), উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস.এম মাজহারুল ইসলাম, থানা অফিসার ইনচার্জ মজিবুর রহমান, আওয়ামীলীগ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের নেতাকর্মী-সমর্থক, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাংখী, সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশাজীবিসহ বিপুল সংখ্যক মুসুল্লী শামীমের জানাজায় অংশ নেয়। এ সময় পুলিশ সুপার নিহত পুলিশ কনস্টেবল শামীমের পরিবারকে পুলিশ বাহিনী তথা সরকারের পক্ষে সম্ভাব্য সবধরনের সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে শামীমের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।