৬ মাস আগে বাড়িজুড়ে উৎসবের আমেজ ছিল। দিন নেই, রাত নেই লোকজনের আনাগোনা ছিল বাড়িতে। সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সৌদি প্রবাসী মাসুক মিয়া। নির্বাচনে সফল না হয়ে মাসুক মিয়া আবার ফিরে যান সৌদি আরবে। জেদ্দায় তার দোকান শাহিন অ্যান্ড আজিজ ক্লথ স্টোর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আবার। কমে যায় তার বাড়িতে লোকের ভিড়। এখন আবার সে বাড়িতে লোকের আনাগোনা। তবে বাড়িজুড়ে এখন শোকের আবহ। মাসুক মিয়ার একমাত্র মেয়ে খাদিজা আক্তার নার্গিস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে। মেয়ের খবরে মন চাইছে উড়াল দিয়ে চলে আসার। দূর দেশ থেকে চাইলেই যখন-তখন ছুটে আসা যায় না। মাসুক মিয়া চেষ্টায় আছেন যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরার। যেকোনো সময়ই বাংলাদেশের পথে উঠে পড়বেন বিমানে। সময় যেনো তার কাটছে না। চোখের সামনে কেবলই ভাসছে মাস কয়েক আগে দেশ থেকে নিয়ে আসা মেয়ের মুখের স্মৃতি। যে স্মৃতিতে মেয়ে তার কেবলই হাসছে, ছুটছে। মাসুক মিয়ার চোখের জলে ভিজছে কেবলই সেসব স্মৃতি।
মেয়ে যে মৃত্যুশয্যায় তা জানেন না মা মনোয়ারা বেগম। প্রথমদিকে তাকে শুধু জানানো হয়েছিলো তার আদরের মেয়ের কপালে একটু আঘাত লেগেছে হাসপাতালে আছে, সামান্য চিকিৎসার পর সেরে যাবে। তবে বাড়িতে লোকের আনাগোনায় তিনি বুঝতে পারেন বড় ধরনের ক্ষতিই হয়েছে তার মেয়ের। বারেবারে জিজ্ঞাসায় শেষে তাকে জানানো হয়েছে খাদিজাকে কোপ মারা হয়েছে, তবে অবস্থা তেমন গুরুতর নয়। যতই মিথ্যা আশ্বাসে ভোলানোর চেষ্টা করা হোক না কেনো মায়ের মন কী করে জানি টের পেয়ে যাচ্ছে মেয়ে তার ভালো নেই, বারবারই তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন।
৩ ভাইয়ের ১ বোন খাদিজা। বড় ভাই শাহীন আহমদ চীনে ডাক্তারি পড়ছেন। ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে সালেহ আহমদ সিলেট নগরীর সেন্ট্রাল কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। সবার ছোট জুবায়ের আহমদ মাদরাসার ছাত্র। তিন ভাইয়ের আহ্লাদি বোন খাদিজার জন্য চোখ জলে ভাসছে তাদের ভাইদেরও। অজানা আশঙ্কায় বারবারই বুক ধুকপুক করছে। যার সঙ্গে কথা হয়, দেখা হয় তারা কেবলই বোনের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন সবার কাছে। কারণ আর কিছু করার নেই। মঙ্গলবারই ডাক্তার বলে দিয়েছেন ৭২ ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাবে না, অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। ফোনে তাই রিং এলেই ভয় ধরে যায় ছোট ভাই সালেহ আহমদের মনে। কোনো দুঃসংবাদ এলো কিনা?
খাদিজাদের যৌথ পরিবার। ৪ চাচা তার। পুরো পরিবারটি জুড়েই শোকের ছায়া। খাদিজার চাচা আবদুল কুদ্দুস বললেন তার ছোট দুই মেয়ে সাবিহা নুজহাত তানিয়া ও মিনহা মাহদিয়া সাফা কেবলই কাঁদছে খাদিজার জন্য। এর মধ্যে সাফা তো খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, কেবলই কাঁদছে। পণ করেছে, ‘দিদিমণিকে ছাড়া ভাত খাবে না সে। তানিয়া ও সাফা খাদিজাকে দিদিমণি বলেই ডাকে এমনটিই জানালেন আবদুল কুদ্দুস।
চাচাতো ভাই মকবুল হোসেন ঢাকায় আছেন বোনের সঙ্গে। হাসপাতালের বাইরে কেবলই পায়চারি করছেন তিনি। চোখে ভাসছে বোনের স্মৃতি। খুবই শান্তশিষ্ট মেয়েটি। তার যে এমন ক্ষতি করতে পারে কেউ কিছুতেই ভাবতে পারছেন না মকবুল হোসেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা খাদিজার ক্ষত-বিক্ষত চেহারা দেখলেই বুকটা যেনো ফেটে যেতে চায় মকবুল হোসেনের।
খাদিজা ২১ পেরিয়েছে মাত্র ২১ দিন হলো। ১৯৯৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তার জন্ম। পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী মেয়েটি। হাজী সফির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ২০১২ সালে এসএসসিতে ৪.৩১ জিপিএ পয়েন্ট নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলো। দু’বছর পর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩.৭৫ জিপিএ পয়েন্ট এইচএসসি উত্তীর্ণ হয় সে। তারপর বিএ’তে ভর্তি হয় সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে। সিলেট শহরতলির আউশা গ্রামের বাড়ি থেকেই সে কলেজে আসা-যাওয়া করতো। ক্লাস শেষেই সে বাড়ি ফিরে আসতো। কোথাও আড্ডা দেয়া বা থামাথামির অভ্যাস ছিল না তার। সেই মেয়েটি সোমবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। সেদিন পরীক্ষা দিতে এমসি কলেজে গিয়েছিল খাদিজা। ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে পরীক্ষা শেষে ফেরার পথে কলেজ ক্যাম্পাসে তার ওপর চাপাতি দিয়ে হামলা চালায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক ও অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র বদরুল আলম। যে এক সময় খাদিজাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতো। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধারের পর খাদিজাকে প্রথমে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় এখন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে খাদিজা।
খাদিজার সুস্থ হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে তার পরিবার। খাদিজা সুস্থ হয়ে ফিরে যাক সে প্রত্যাশা পুরো বাংলাদেশেরও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় পাতায় এখন খাদিজার জন্য শুভ কামনা। শুধু প্রার্থনা, ‘ফিরে এসো খাদিজা’।