আরো তিন বছরের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব নিলেন শেখ হাসিনা। এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলের সভাপতির দায়িত্ব পেলেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আরেক স্বপ্নবান রাজনীতিক ওবায়দুল কাদের। তিনি দলের বিদায়ী কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। একই সঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। এ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করে চমক দেখানো ওবায়দুল কাদের এবার দলের গুরুদায়িত্ব মাথায় নিলেন। তার নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে অবসান হলো সম্মেলনকে ঘিরে গত কয়েক দিনের নানা জল্পনার। ওবায়দুল কাদের সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হলেন। আশরাফ পর পর দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
নতুন সাধারণ সম্পাদক কে হচ্ছেন এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল দলের ভেতরে-বাইরে। দেশবাসীরও কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল ক্ষমতাসীন দলের এ পদটি ঘিরে। গতকাল বিকালে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে দলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এ অধিবেশনে সংশোধিত গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র অনুমোদন দেন কাউন্সিলররা। অধিবেশনের শুরুতে দেয়া বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে কাউন্সিলরদের প্রতি আহ্বান জানান। এসময় তিনি বলেন, আমি থাকতে থাকতে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করুন। এসময় কাউন্সিলররা না না বলে জবাব দেন।
নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলে দলের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করেন সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সিনিয়র সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তাকে সমর্থন করেন আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এ পদে আর কোনো নাম প্রস্তাব না আসায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। পরে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নাম ঘোষণা করেন বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তাকে সমর্থন দেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক। এ পদে আর কোনো প্রার্থীর নাম না আসায় নির্বাচন কমিশনার তাকেও নির্বাচিত ঘোষণা করেন। এরপর কাউন্সিলররা কমিটির বাকি সদস্যদের নির্বাচিত করার ক্ষমতা দলীয় সভাপতির ওপর অর্পণ করেন। পরে দলীয় সভাপতির অনুমোদন সাপেক্ষে প্রেসিডিয়ামের ১৪ জন ও চার জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষের নাম ঘোষণা করা হয় অধিবেশন কক্ষে। প্রেসিডিয়ামের ১৪ জনের মধ্যে সাত জনই নতুন মুখ। আর চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে নতুন একজন। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে এইচএন আশিকুর রহমানই বহাল আছেন। এদিকে কাউন্সিল অধিবেশনে দলীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর ওবায়দুল কাদের দলীয় সভানেত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করেন। এসময় তিনি বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। নতুন সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে দল আরো শক্তিশালী হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওবায়দুল কাদেরের নাম ঘোষণা করায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ও আমার ছোট ভাইয়ের মতো। শহীদ পরিবারের সন্তান। সম্মেলনস্থল থেকে বের হওয়ার সময় সৈয়দ আশরাফকে জড়িয়ে ধরেন শেখ হাসিনা। এসময় দুজনই আবেগ আপ্লুত ছিলেন।
’৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর বিদেশে অবস্থান করে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। অবশ্য তার আগেই দলের অন্য নেতারা তাকে দলের সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। এরপরই দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নিরন্তর সংগ্রাম। পর পর সাত দফায় দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। ২০তম সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এ পদে নতুন নেতৃত্ব আনতে দলের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। যদিও তার এ বক্তব্যে না সূচক জবাব দিয়েছিলেন নেতারা। সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনেও একই ধরনের আহ্বান জানালে তা ফিরিয়ে দেন কাউন্সিলররা।
ছাত্রনেতা থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক: আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন সক্রিয় ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে। ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা কাদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবেও তিনি এলাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। তার নেতৃত্বে দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। ওবায়দুল কাদেরের জন্ম নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড় রাজাপুর গ্রামে ১৯৫২ সালের ১লা জানুয়ারি। তার বাবার নাম মোশাররফ হোসেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ওবায়দুল কাদেরের মায়ের নাম ফজিলাতুন্নেসা। বসুরহাট সরকারি এএইচসি হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি মেধাতালিকায় স্থান পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইসরাতুন্নেসা একজন আইনজীবী। ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ওবায়দুল কাদের। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও ছিল তার সক্রিয় ভূমিকা। ওবায়দুল কাদের একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুজিব বাহিনীর কোম্পানীগঞ্জ থানার কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ঘটনার পর ওবায়দুল কাদের কারাবরণ করেন। আড়াই বছর তিনি কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। পরপর দুবার এ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৫ আসন থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এসময় তিনি সরকারের যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের বিদায়ী কমিটির তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৯ই মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে ১৭ মাস ২৬ দিন তিনি কারাগারে ছিলেন। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের ৫ই ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-৫ আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১২ই জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। রাজনীতির পাশাপাশি ওবায়দুল কাদের লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত। এক সময় সাংবাদিকতাও করেছেন। ছিলেন বাংলার বাণী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। এ পর্যন্ত তার আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।