বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলাটি পরিচালনার আগে তামিম আহমেদ চৌধুরী ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিগোষ্ঠীর অনুমোদন চান। তাকে অনুমোদনও দেয় আইএস। জঙ্গিগোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই কানাডিয়ান নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন আবু তারেক মোহাম্মদ তাজুদ্দিন কাওসার। কাওসার তাকে হামলায় বিদেশিদের টার্গেট করার নির্দেশনা দেন। এ দু’জনের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া বার্তা দেখেছেন, এমন এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা এ তথ্য দিয়েছেন। ওই সময় তামিম চৌধুরী বাংলাদেশেই অবস্থান করছিলেন। বিদেশিদের নিয়মিত যাতায়াত আছে এমন একটি রেস্তরাঁয় হামলা চালানোর প্রস্তাব করেন তিনি।
১লা জুলাই শহরের গুলশান এলাকায় হলি আর্টিজান ক্যাফেতে একদল বন্দুকধারী রাতভর জিম্মিদশা সৃষ্টি করে। তাদের হাতে নিহত হন ২২ জন, যাদের বেশির ভাগই বিদেশি। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো দেশ। তামিম চৌধুরী (৩০) ও কাওসারের (৩৫) মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া নথিপত্রের বিষয়টি আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। তবে তারা কয়েকটি নিবন্ধের খসড়াও আদান-প্রদান করেছিলেন যা পরে আইএস’র নিজস্ব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন ও জনবল সংগ্রহে আইএস-সংশ্লিষ্ট লোকজনের চেষ্টা এবং উদ্ধারকৃত নথিপত্র প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে পূর্বের অনুমানের চেয়েও গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছিল আইএস। তথ্যের সংবেদনশীলতার কারণে ওই পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশে সম্মত হননি। দুই জঙ্গির যোগাযোগের বিষয়টি রয়টার্স স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি।
নিজেদের মূল ঘাঁটি ইরাক ও সিরিয়ায় ব্যাপক চাপে আছে আইএস। তাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের মতো বাইরের দেশগুলোতে সংগঠনটির কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশে আইএস’র প্রভাবের বিস্তৃতি কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করবে দেশটির গার্মেন্ট খাত। এ খাতে লাখো লোক কর্মরত রয়েছে। প্রতি বছর রপ্তানির মাধ্যমে ২৮০০ কোটি ডলার আয় করে এই খাত। বাংলাদেশে বৈশ্বিক জিহাদি নেটওয়ার্কগুলো সক্রিয়- এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলে, পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো সস্তা পোশাকের জন্য অন্য উৎস খোঁজা শুরু করবে। গুলশান ক্যাফে হামলার আগের বছর, ব্লগার ও বিদেশি সহ বহু ব্যক্তিবিশেষের ওপর একাধারে হামলা চালানো হয়। তখনই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে উঠেন। ক্যাফে হামলার পর নিজেদের রুমিয়া ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আইএস দাবি করে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের পর বাংলাদেশে দুই ডজন হামলা চালিয়েছে তাদের সদস্যরা। তবে এ দাবি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা যায়নি।
স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নাকি আইএস?
গুলশান হামলার পর, পুলিশ সন্দেহভাজন জিহাদি আস্তানায় অভিযান চালায়। পুলিশ জানায়, তারা কয়েক ডজন জঙ্গিকে হত্যা করেছে। আটক করেছে আরো কয়েক শ’ জনকে। তবে এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বলছে, বাংলাদেশে আইএস’র কোনো অস্তিত্ব নেই। তিনি বরং রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির দায় চাপান বিরোধী ইসলামিস্টদের ওপর। বিরোধী দলগুলোর নেতারা কোনো ধরনের যোগসূত্রের কথা অস্বীকার করেছেন। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রয়েছে হাসিনার শাসক দল আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও জামায়াতের তিক্ত বৈরিতা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এরা সকলেই স্থানীয়।’ তিনি বলেন, জিম্মিদশার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরা জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) এক নতুন শাখার সদস্য। তিনি বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত গোষ্ঠীটির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর।
এদিকে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত বছরের শেষের দিকে তামিম চৌধুরীর কথা প্রথম জানতে পারে বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু তার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য ছিল না। ডিসেম্বরের দিকে ঢাকার পুলিশ প্রায় ৩৯ লাখ টাকা আটক করে। এই টাকা যাওয়ার কথা তামিম চৌধুরীর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর কাছে। পুলিশ কর্মকর্তা জানান, একটি হুন্ডি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এ টাকা দেশে পাঠানো হয়। অর্থের যোগানদাতা ছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি কোম্পানি। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল সুজন কয়েকদিন পর সিরিয়ায় নিহত হন। পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওই সময় তদন্তকারীদের কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না যে, এই অর্থ পাঠানো হয়েছে আইএস’র নির্দেশনা অনুযায়ী।
এদিকে তামিম চৌধুরীর গ্রুপ তখন সদস্য সংগ্রহ করছিল। তানভির কাদেরি ও তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবার। তারা সচ্ছল জীবনযাপন করছিলেন। তাদের দুই সন্তান। চাকরিও স্বাভাবিক। কাদেরির ছেলে মোহাম্মেদ তাহরিম কাদেরি আবির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপিত স্বীকারোক্তিতে লিখেন, ‘আমরা খুবই সুখী একটি পরিবার ছিলাম।’ অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আবির লিখেন যে, ২০১৪ সালে হজ পালনের পরই তার পিতা-মাতার আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। এরপর কাদেরি এক ‘ধর্ম প্রচারকে’র (প্রিচার) কাছে বলেন যে, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন তিনি একটি মরুভূমির মাঝখানে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। স্থানীয় মসজিদের স্বল্পপরিচিত লোকজনের সঙ্গেও সময় কাটাতে থাকেন কাদেরি। এই লোকজন কাদেরি ও তার পরিবারকে অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এদের মধ্যে ছিল তামিম চৌধুরীর সহযোগীরাও। আবিরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তামিমের সহযোগীরা কাদেরি পরিবারকে ধর্মবিশ্বাস ও জিহাদ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। সিরিয়ার যুদ্ধের ভিডিও’ও দেখায়। এদের একজন আইএস’র দাবিক ম্যাগাজিনের একটি কপিও দেয়।
আবিরের স্বীকারোক্তি মোতাবেক, ক্যাফে হামলার প্রস্তুতি শুরু হয় কমপক্ষে জুন থেকে। তখন মুসলিমদের পবিত্র মাস রমজান শুরু হচ্ছিল। কাদেরি ক্যাফের কাছে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। এর কয়েকদিন পর ওই বাড়িতে হাজির হয় ৫ ব্যক্তি- যারা পরে ঢাকা হামলা পরিচালনা করে। হামলার রাতে কাদেরি পরিবার চলে যায় পুরান ঢাকায়।
ম্যাগাজিন সাক্ষাৎকার
২৭শে আগস্ট এক অভিযানে তামিম চৌধুরী নিহত হয়। সেই অভিযান ও অন্যান্য আরো অভিযান চালিয়ে পুলিশ তামিমের সঙ্গে কাওসারের বার্তা খুঁজে পায়। একটিতে দেখা যায়, একটি সাক্ষাৎকারের জন্য চৌধুরীকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে বলছেন কাওসার। ওই সাক্ষাৎকার পরে এপ্রিলে দাবিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এতে তামিমের নাম দেয়া হয় আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। ম্যাগাজিনে আল-হানিফকে বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের প্রধান হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়। আরেকটি বার্তায় দেখা যায়, ক্যাফে হামলার ব্যাপারে লেখা একটি নিবন্ধের খসড়া কাওসারকে পাঠায় তামিম। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তার মৃত্যুর পরে রুমিয়া ম্যাগাজিনে ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
কাওসারের মা তাহেরা বেগম জানান, ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায় সে। কিন্তু হামলার আগ থেকেই ছেলের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। ঢাকা থেকে ১৩৫ মাইল দূরের একটি ছোট শহরে বসবাস তাহেরার। তিনি বলেন, কাওসারের সঙ্গে আইএস’র কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, তা তার জানা নেই।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নিজের মৃত্যুর আগে, কাদেরিকে কাওসারের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন মাধ্যম বানিয়েছিলেন তামিম। ১০ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে, কাদেরির অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় কড়া নাড়ে পুলিশ। সেখানে তার স্ত্রী, এক ছেলে ও কিছু সহযোগী লুকিয়ে ছিল। এ সময় পুলিশের ওপর গ্রেনেড ও ছুরি দিয়ে আক্রমণ করা হয়। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরের কয়েক জন মহিলা পুলিশের দিকে মরিচের গুঁড়া নিক্ষেপ করে। কাদেরি পাশের এক রুমে দৌড়ে চলে যান। পুলিশ তাকে ধরার চেষ্টা করলে, তিনি পুলিশকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চেষ্টা করেন। পুলিশ তার ছেলেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিল। এ সময় তিনি ছেলেকে বলেন, ‘তুমি যদি মারা যাও, তুমি হয় শহীদ হবে, অন্যথায় আল্লাহ তোমাকে পুরস্কৃত করবেন।’ এই অভিযান যখন শেষ হলো, ততক্ষণে কাদেরি নিজের গলা নিজেই কেটে ফেলেছেন। আর তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই চাপা পড়ে যায় বাংলাদেশে আইএসের সর্বশেষ জ্ঞাত যোগসূত্র। তবে পুলিশ জানিয়েছে, অন্য কেউ জঙ্গিগোষ্ঠীটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে কিনা, তা তাদের জানা নেই।
রাজনৈতিক বৈরিতা
বিরোধী নেতাদের অভিযোগ সরকার ভিন্নমত দমনে জঙ্গিবাদকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এক ধরনের গণতন্ত্রের সংকট নিশ্চিতভাবেই চরমপন্থিদের উৎসাহিত করছে।’ মির্জা ফখরুল কয়েক মাস কারাগারে ছিলেন। এখন তিনি আরো কয়েক ডজন মামলার মুখোমুখি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে গত দুই বছরে জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপর জামায়াত নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে চলে যান। এক ই-মেইলে দলের প্রধান মকবুল আহমাদ জেএমবি বা অন্য কোনো জঙ্গিদের সঙ্গে তার দলের কোনো ধরনের সংযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের আসল উপস্থিতির বিষয়টি ক্রমাগত অস্বীকার করে যাচ্ছে। বরং, তারা একে ইসলামপন্থিদের দমনে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে।’
ক্যাফে হামলার কিছুকাল পরে, তামিম চৌধুরীকে ধরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে ২০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। এরপর জঙ্গি আস্তানায় একাধিক অভিযান চালানো হয়। পুলিশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩ রা অক্টোবরের মধ্যে পুলিশ ৪২ জঙ্গিকে হত্যা করেছে। আটক করেছে কমপক্ষে ২২১ জনকে। আল কায়েদার সঙ্গে আদর্শগতভাবে সংশ্লিষ্ট এমন একটি গ্রুপ সহ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এখন নীরব হয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে হুমকি এখনো শেষ হয়নি।