চলতি মাসের শেষে নতুন কাফালা নীতিমালা কার্যকর হলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিতাড়িত হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে ফিফার বিরুদ্ধে কাতারে শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার প্রতিকার চেয়ে মামলা করলেন কাতারে কর্মরত এক বাংলাদেশি। অভিবাসী সকল শ্রমিকের পক্ষে নেদারল্যান্ডসের একটি সংগঠন সুইজারল্যান্ডের আদালতে ওই মামলা করেছে । ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে কাতারের অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারভঙ্গের অভিযোগে ফিফার বিরুদ্ধে সুইস আদালতে গত বৃহস্পতিবার ওই মামলা করা হয়। খবর দি গার্ডিয়ান, সিএনএন।
নেদারল্যান্ডস ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (এফএনবি) নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক নাদিম শরাফুল আলমের পক্ষে ফিফার বিরুদ্ধে ওই আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এবং ইতিমধ্যে ফিফাকে এ বিষয়ে জুরিখের একটি বাণিজ্যিক আদালতে হাজির হতে তলব করা হয়েছে। এতে এ মর্মে ফিফার বিরুদ্ধে রুল জারির অনুরোধ করা হয়েছে যে, কাফালা পদ্ধতি বাতিলসহ মৌলিক মানবাধিকার এবং অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার শর্ত পূরণের অঙ্গিকার নিশ্চিত করা ছাড়াই কাতারকে ফিফা কেন বেছে নিয়েছে।
সিএনএন বলেছে, কাতারে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের ৯০ ভাগই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে এসেছেন। আর চলতি মাসের শেষ দিকে পরিবর্তিত কাফালা নীতিমালা কার্যকর হতে পারে। এতে চাকরির শর্তে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, গত অক্টোবরে দি গার্ডিয়ানে বিশ্বকাপ আয়োজন সংক্রান্ত নির্মাণ কাজে জড়িতদের শ্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট ছাপা হলে তা আলোড়ন তৈরি করে। এরপর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘সুন্দর খেলার কুৎসিত দিক’ বিষয়ক ৮০ পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে সেমি ফাইনালের জন্য প্রস্তাবিত খলিফা স্টেডিয়াম নির্মাণ বা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইন ও বেয়ার্ন মিউনিখের মতো ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবের জন্য বরাদ্দ করা এলাকার শ্রীবৃদ্ধি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরা হয়। কর্মরত শ্রমিকরা তাদের নিজ দেশের নিয়োগকারী সংস্থাকে ৪ হাজার ডলারের বেশি দিতে বাধ্য হয়েছেন কিংবা ন্যায্য মজুরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
সুইস আদালতে মামলার বিষয়ে ফিফা কোনো মন্তব্য করেনি তবে এ মাসের গোড়ায় কাতারের সাংগঠনিক কমিটির মহাসচিব হাসান আল থাওয়াদি বলেছেন, ‘২০২২ ফিফাকাপ একটি সেতু ও মঞ্চ যা মানুষকে একত্রিত করবে। তবে এখন সমালোচনা মোকাবিলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অসত্য তথ্য ছড়ানো হচ্ছে যা সত্যের অপলাপ।’
বহু বাংলাদেশি শ্রমিক, যারা কাতারে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং বাংলাদেশ বিল্ডিং ফুড ওয়ার্কাস ফেডারেশনের সদস্য ছিল, তারা এই আইনগত লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। সিএনএন জানিয়েছে, কাতার চলতি মাসেই তাদের অভিবাসী শ্রমিকদের যোগ্যতা নির্ধারণী সংশোধিত কাফালা নীতিমালা চালু করতে পারে। এফএনবির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সুইস আদালতকে এ মর্মে রুল জারি করতে বলা হয়েছে যে, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানে কাতারকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে কাতার মৌলিক মানবাধিকার এবং অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার কাফালা পদ্ধতি বাতিলসহ নিশ্চিত করার দাবি পূরণের শর্ত না দিয়ে কেন দেশটিকে বাছাই করা হয়েছে।
সুইস আদালতকে তার রুলের শর্তে একথা যুক্ত করতেও অনুরোধ করা হয়েছে যে, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠান পর্যন্ত ফিফা নিশ্চয়তা দেবে যে অভিবাসী নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা দেয়া হবে। তারা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় শ্রমক্ষেত্রে কার্যকর ও পর্যাপ্ত সংস্কার আনবে। আর তার প্রকৃত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং বাংলাদেশ বিল্ডিং ফুড ওয়ার্কাস ফেডারেশনকে মামলার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার কারণ হলো তাদের সমিতিভুক্ত অনেকেই কাতারে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে। এই ইউনিয়নগুলো বিদেশি শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিক বিশেষ করে কাতারে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বৈশ্বিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বলে গার্ডিয়ান রিপোর্ট করেছে।
১০ই অক্টোবরে ফিফাকে উক্ত দাবিসমূহের ব্যাপারে অবগত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে তারা অবশ্য নাকচ করে দিয়েছে। ফিফার সাস্টেইনাবিলিটি বিভাগের প্রধান ফেডিরোকো আদিচি চার মাস আগে জারি করা এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় একটি বিবৃতি দিয়েছিল। ঐ বিবৃতিতে মি. আদিচি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, ফিফা পরিচালনা পরিষদ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানে সর্বত্র যাতে মানবাধিকারের সুরক্ষা থাকে তা বজায় রাখতে ফিফা সম্পূর্ণরূপে সংকল্পবদ্ধ। ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত সকল অপারেশনস এবং সার্ভিস সংশ্লিষ্ট বিষয়েও একই শর্ত প্রযোজ্য হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
গার্ডিয়ান রিপোর্টে আরো বলা হয়, যদিও বাংলাদেশি শ্রমিক আলম যে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন তা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু যদি তাদের এ আইনি পদক্ষেপ সাফল্যের মুখ দেখে তাহলে একই ধরনের অভিযোগ উত্থাপনে শত শত অভিবাসী শ্রমিকের জন্য তা সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। আর তখন ক্ষতিপূরণের টাকাও লাখ লাখ পাউন্ড ছাড়িয়ে যাবে; যা বিশেষভাবে ঘটবে তা হলো, আসন্ন বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের গ্রহণযোগ্যতা আরো বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।