মহাসড়কে অব্যাহত যানজট। তীব্র এ যানজটে মহাদুর্ভোগে ঘরমুখো যাত্রীরা। ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা বাসের ভেতর বসেই কাটাতে হচ্ছে যাত্রীদের। পথে পথে এত যন্ত্রণা নিয়েও মানুষ প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ি ফিরছেন। গতকাল ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষের ঢল ছিল রাজধানীর রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে। ভোর থেকে ঘরমুখো মানুষ পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান বাড়ির পানে। মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে গ্রামমুখী যাত্রীদের নিয়ে একের পর এক বাস ছেড়ে গেছে। দিনভর যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। এবারের ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে বুধবার থেকে। অনেকেই শুরুর দিন পরিবার আগে বাড়ি পাঠিয়েছেন। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজে কর্মদিবসে হাজিরা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাড়ির উদ্দেশে বৃহস্পতিবার। অনেকে আবার আরাম আয়েশ করে শুক্রবার রওনা দেন। গার্মেন্টস কর্মীসহ বেসরকারি কিছু অফিস কর্মীরা আজ শনিবার যাত্রা করবেন। এদিকে, দু-একটি ট্রেন সামান্য দেরিতে ছেড়ে গেলেও বাড়তি চাপ ছিল সব ট্রেনেই। ট্রেনের ছাদে চড়ে ও গেটে দাঁড়িয়ে অনেককে বাড়ি যেতে দেখা যায়। প্রচণ্ড ভিড়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে অনেক যাত্রীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী জানান, অধিকাংশ ট্রেন ছেড়ে গেছে সঠিক সময়ে। তবে রংপুর এক্সপ্রেস দেরিতে ছেড়েছে। ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে বাসস্ট্যান্ডে। অগ্রিম টিকিট কিনেও বাসের জন্য বসে ছিলেন যাত্রীরা। সমস্যা হতে পারে এ বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে টার্মিনালে আসেন যাত্রীরা। অন্যদিকে সকাল থেকেই আস্তে আস্তে সদরঘাটে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে লঞ্চযাত্রীরা আগেভাগেই ঘাটে পৌঁছান। কাঙিক্ষত লঞ্চের অপেক্ষায় হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন টার্মিনালে। বিকাল গড়াতে লঞ্চগুলো যাত্রীবোঝাই করে টার্মিনাল ছেড়ে গেছে। বরিশালগামী যাত্রী ইব্রাহিম বলেন, ঈদের সময় বাড়ি যেতে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তারপরও বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদে বাড়ি থাকলে আনন্দের কমতি থাকে না।
মানিকগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, গতকালও দিনভর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার মানুষ অসহনীয় ভোগান্তির শিকার হন পাটুরিয়া ঘাটে। ভোর থেকে সারা দিনই অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো ঘাট এলাকা। ফেরি স্বল্পতায় ভোগান্তিতে পড়ড়ে হয় যাত্রীদের। ফলে ঈদে ঘরমুখো হাজার হাজার যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় আটকে থাকেন। ঘাট ছাড়িয়ে যানবাহনের লম্বা লাইন প্রায় ৫ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়।
সরজমিন পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির করুণ দৃশ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ বহনকারী বাস, কোচ, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারগুলো সারি সারিভাবে অপেক্ষা করছে পাটুরিয়া ঘাটে। ঈদ উপলক্ষে এই নৌরুটে ১৯টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপারের কথা থাকলেও বাস্তবে ফেরি চলছে ১৫টি। এর মধ্যে বড় ফেরি (রো রো) ৭টি, মাঝারি (কে-টাইপ) ফেরি দুটি ও ছোট ফেরি (ইউটিলিটি) ৬টি। যানবাহনের চাপ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই তুলনায় বর্তমানে ফেরি সংকট দেখা দিয়েছে। ১৫টি ফেরির সঙ্গে আরো চারটি ফেরি যুক্ত হলে ভোগান্তির মাত্র অনেকাংশ কমে যেত বলে জানিয়েছেন যাত্রী, পরিবহন চালকরা ও ঘাট কর্তৃপক্ষ। প্রচণ্ড গরমে সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসেই সময় কাটাতে হয়েছে হাজার হাজার যাত্রীকে। এতে সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং নারী যাত্রীরা।
যশোরগামী যাত্রী শহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারে পরিবার নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে সকাল ১১টা থেকে বসে আছি। ঘাট থেকে আমার গাড়ি কমপক্ষে ৪ কিলোমিটার দূরে। কখন ফেরির কাছে যেতে পারবো এবং বাড়ি ফিরতে পারবো জানি না।
জে আর পরিবহনের যাত্রী কলেজ শিক্ষার্থী নভেলা বলেন, সকাল ১০টায় ঘাটে এসেছি। দুপুর আড়াইটা পার হলেও ফেরির কাছেই ভিড়তে পারছি না। কখন ফেরি পাবো আর কখন বাড়ি ফিরবো। শুনেছি ফেরি কম থাকায় খুবই ধীরগতিতে যানবাহন পারাপার হচ্ছে।
ঈগল পরিবহনের যাত্রী হাফিজুর রহমান জানালেন, কোনো ঈদে একটু স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে পারি না। চরম দুর্ভোগ আর কষ্টকে সঙ্গী করেই ফিরতে হয় প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ শেয়ার করার জন্য। এভাবে আর কত দিন চলবে?
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা সেক্টরের এজিএম জিল্লুর রহমান জানান, পাটুরিয়া ঘাটে ঈদমুখো মানুষ এবং যানবাহন পারাপারের জন্য আমাদের বর্তমান ফেরির বহরে আরো দুটি ফেরি যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও দুঃখের বিষয় তা হচ্ছে না। যার ফলে ফেরি স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে বড় গাড়ির চেয়ে ছোট গাড়ির চাপ অনেক বেশি। ৫নং ফেরিঘাট ছাড়িয়ে ছোট গাড়ির লাইন প্রায় ৬ কিলোমিটার অতিক্রম করেছে। ঘাটে বড় বাসের চাপও বেশি। এছাড়া টার্মিনালে ৫ শতাধিক ট্রাক আটকে আছে।
গাজীপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঈদের ঘরমুখো মানুষের স্রোতের কারণে যানবাহনের দীর্ঘ যানজট দেখা গেছে। এতে মহাসড়কের গাজীপুর অংশের অনেক স্থানেই দিনভর গাড়ি চলেছে থেমে থেমে। কয়েকটি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে থেমে থেমে যানজট। তবে প্রয়োজনের তুলনায় যানবাহন সংকটে বিড়ম্বনায় পড়েছেন ঘরমুখো যাত্রীরা। অনেকেই বাস, ট্রাক পিকআপ ভ্যানের ছাদে করে এবং হালকা যানবাহনে যাচ্ছেন দূরদূরান্তে। এতে বাড়তি ভাড়াও গুনতে হয়েছে যাত্রীদের। সড়ক পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে পুলিশের আইজিপি একেএম শহীদুল হক বিকালে গাজীপুরের চন্দ্রা মোড় পরিদর্শন করেছেন। হাইওয়ে পুলিশ জানায়, সকাল থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা, কালিয়াকৈর ও খাড়াজোড়া এলাকায় যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। এতে ওই মহাসড়কে ছিল যানবাহনের লম্বা সারি। ফলে চন্দ্রা ও কালিয়াকৈর অংশে থেমে থেমে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তায় যানবাহনের চাপ লক্ষ করা গেছে। এতে এই অংশ দিয়ে যানবাহন চলেছে ধীরগতিতে।
অন্যদিকে, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীবাহী বাড়তি যানবাহনের চাপে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বঙ্গবন্ধু সেতু-টাঙ্গাইল-ঢাকা মহাসড়কে অন্তত ২৫ কিলোমিটারজুড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় থেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রাবনা বাইপাস পর্যন্ত যানজট ছাড়িয়ে গেছে।