ত্রাণের জন্য প্রতীক্ষা অভূক্ত বন্যার্তদের। পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন কাটছে অর্ধহারে অনাহারে। এ দুর্দিনে সরকারের তরফে এ পর্যন্ত যে ত্রাণ সহায়তা আসছে তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া বরাদ্দগুলোও সঠিকভাবে দুর্গতদের হাতে না পৌঁছার অভিযোগ উঠছে। এ কারণে বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় তোপের মুখে পড়ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ঘটছে এমন নানা অনভিপ্রেত ঘটনাও। এরপর দফায় দফায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সব। বিপর্যস্ত হাওর পাড়ের মানুষ। সর্বশেষ বন্যায় তলিয়ে দিয়েছে তাদের মাথাগুঁজার ঠাঁইও। সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব হাওর পাড়ের বাসিন্দারা। গেল ক’দিন থেকে থামছে না উজানের পাহাড়ী ঢল আর বৃষ্টি। তাই বানের পানি কমারও কোনো লক্ষণ নেই। বরং বাড়ছে পানি। আর ডুবছে নতুন নতুন এলাকা। হাকালুকির হাওর তীরবর্তী কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার প্রায় ২৫টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রাম এখন বন্যাকবলিত। এসব এলাকায় বন্যা যত স্থায়ী হচ্ছে ততই বাড়ছে দুর্ভোগ। ঘর বাড়ি হারা মানুষ ইতিমধ্যেই ঠাঁই নিয়েছেন অন্যত্র। নিজের আত্নীয় স্বজন কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানেও তারা পানিবন্দি। নানা সমস্যা ও সংকটে ওই আশ্রিত স্থানেও চরম বিড়ম্বনা। ঘরে চাল নেই। নেই নুন, মরিচ তেলও। রান্নার উপকরণ আর অনুসঙ্গ সবই অর্পযাপ্ত। তাই অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে তাদের দিন। বানের পানিতে সবই তলিয়ে যাওয়ায় নেই আয় রোজগার। ঘরের উর্পাজনক্ষম লোকজনও কাটাচ্ছেন কর্মহীন সময়। তাই এখন ত্রাণই তাদের একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা। ত্রাণের জন্য প্রতীক্ষা। ত্রাণ পেলে আহার। না পেলে অভুক্ত থাকছেন তারা। ২০০৪ সালের বন্যার পর এখন এমন দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়েছেন হাকালুকি হাওর তীরের মানুষ। তবে এবারকার বন্যার মতো এতো দুর্ভোগ বা ক্ষতির শিকার হননি হাওর পাড়ের লোকজন। চৈত্রের অকাল বন্যায় তলিয়ে দিয়েছে তাদের সোনালী ফসল বোরো ধান। এরপর পচা ধানের বিষক্রিয়ায় মরেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ, হাঁস, জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ। এরপর ক্রমাগত বন্যায় তলিয়ে গেছে একের পর এক সবজি ক্ষেত, কৃষিজমি,মৎস্য খামার আর গবাদি পশুর খাদ্য ও বাসস্থান। অতিসম্প্রতি সর্বশেষ বন্যায় ডুবিয়েছে বাড়ি ঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপসনালয়। একে একে সবতলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পানি। সময় যত যাচ্ছে পানিতে টইটুম্বর হাওর নিজের জলসীমানা ছাড়িয়ে এখন গিলে খাচ্ছে তীরবর্তী গ্রাম। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন আগে বন্যা হলেও এখনকার মতো এত দীর্ঘস্থায়ী হতো না। কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুমে হাওর যেমন পানি ধরে রাখতে পারে না। এর অন্যতম কারণ হাওরের নাব্যহ্রাস। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকার এই হাওর থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তার ন্যূনতম অংশ যদি হাওর উন্নয়নে ব্যয় করত তাহলে আজ আমাদের এমন দুর্দশা হতো না। তারা বলেন হাকালুকি হাওর দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হলেও আজ পর্যন্ত হাওরটি হাওর উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় নেয়া হয়নি। হাওরটি নিয়ে শিগগিরই কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা না নিলে আগামীতে আমাদের এবারের মত আরো বড় বির্পযয় মোকাবিলা করতে হবে। গতকাল সরজমিনে হাকালুকি হাওর পাড়ের কুলাউড়ার ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুর, মীরশংকর, গৌরিশংকর, কানেশাইল, কানেহাত, বাদে ভূকশিমইল, চকাপন ও জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের শাহপুর ও বেলাগাঁও এলাকায় গেলে চোখে পড়ে ত্রাণের জন্য বন্যার্ত অসহায় মানুষের হাহাকার। হাওর পাড়ের ওই গ্রামগুলোতে কোন অপরিচিত মানুষের নৌকা বিড়তে দেখলে শ’ শ’ নারী, পুরুষ ও শিশু ত্রাণের জন্য ভিড় করছেন। ত্রাণ পেতে তারা হুমড়ি খেয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। আর তাদের অসহায়ত্বের কথা কান্নাজড়িত কণ্ঠে তুলে ধরছেন। জানাচ্ছেন পানিবন্দি অবস্থায় তাদের পরিবার-পরিজনের অভুক্ত থাকার কথা। জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায় সর্বশেষ ২৯ টন জিআর চাউল ও নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ৫৯ হাজার ২০০ ভিজিএফ কার্ডের অনুকূলে ১০ কেজি করে চাউল বিতরণ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে তিন ধাপে ৬৫০ টন চাল, ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছাড়াও তিন মাসের জন্য ৫ হাজার ভিজিএফ কার্ডের অনুকূলে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল এবং ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। তবে হাওর তীরের বন্যা কবলিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা জানান, এ পর্যন্ত ক্ষতিগস্ত মানুষের জন্য যে সরকারি বরাদ্দ এসেছে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ওই বরাদ্দগুলো দুর্ভোগগ্রস্থ সবাইকে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে আমরা তাদের তোপের মুখে পড়ছি। আর নানা মন্দ কথাও শুনতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা গুলোর নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের হিসাব অনুযায়ী আমরা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি। তবে কয়েক দফা বন্যা হওয়ায় বন্যা কবলিত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পরিসংখ্যানও দিন দিন বাড়ছে। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায় কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় হাকালুকি হাওরের পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে না পেরে বন্যার সৃষ্টি হয়ে নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। মার্চ ও এপ্রিলের বন্যার পর এটি মৌলভীবাজারে ৩য় দফা দীর্ঘস্থায়ী বন্যা।