‘অপহরণের’ পর উদ্ধার হওয়া কবি, সাংবাদিক ও কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ভোরে ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। পথিমধ্যে কয়েকজন লোক তাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তোলে। পরে সন্ধ্যার দিকে তার চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে ফরহাদ মজহারকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর তার বরাতে এ কথা জানিয়েছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন। বেলা ১টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে উদ্ধারের পর গতকাল সকাল ৯টার দিকে ফরহাদ মজহারকে আদাবর থানায় নেয়া হয়। সেখান থেকে ১১টার দিকে নেয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে নেয়া হয়। সেখানে ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। পরে বিকালে তাকে নিজ জিম্মায় মুক্তি দেয়া হয়। আদাবর থানা থেকে গতকাল বেলা ১১টার দিকে ফরহাদ মজহারকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে প্রায় ২ ঘণ্টা তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফরহাদ মজহারের বরাত দিয়ে যুগ্ম কমিশনার বলেন, ওইদিন তিনি সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। এরপর বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন লোক তার চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তোলে। কিছুক্ষণ পর তার নিজের ব্যবহৃত নম্বর থেকেই স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ফোন করে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান। পরে আবারো ফোন করেন। জানান, যারা তাকে তুলে নিয়ে গেছে তারা ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে। পুলিশ জানায়, সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগরে খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয় ফরহাদ মজহারকে। আবদুল বাতেন জানান, আদাবর থানায় ফরহাদ মজহারের পরিবারের করা অপহরণের অভিযোগটি মামলা হিসেবে নেয়া হয়েছে। তিনি অপহরণ না স্বেচ্ছায় নিখোঁজ ছিলেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, ওষুধ কেনার জন্য বাসা থেকে বের হন। তাকে কেউ ফোন করেননি। বাসা থেকে বের হওয়ার পরই তাকে জোর করে অপহরণ করা হয়। তবে কিভাবে তিনি যশোর পৌঁছালেন বা কারা তাকে সেখানে নিয়ে গেছে সে সব বিষয় এখনো পরিষ্কার নয়। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি, তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলেও উল্লেখ করেন বাতেন।
এদিকে ডিএমপির কার্যালয়ে উপস্থিত ফরহাদ মজহারের স্ত্রী বলেন, ঘটনার আগের দিন (রোববার) রাত ১১টার দিকে তার স্বামী ঘুমিয়ে ছিলেন। প্রতিদিন ভোর চারটায় তিনি ঘুম থেকে জেগে যান। এরপর কম্পিউটারে বসে টাইপ করেন। ঘটনার দিন টাইপের শব্দ শুনতে না পেয়ে তিনি বাসার বিভিন্ন কক্ষে খোঁজ করেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। কিছুক্ষণ পর ফরহাদ মজহারের নিজের নম্বর থেকেই তাকে ফোন করেন। ফোনে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ এ কথা বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। একঘণ্টা পর আবারো ফোন করেন। তখন বলেন, ৩৫ লাখ টাকা পেলে ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে। এরপর দিনের বিভিন্ন সময় আরো কয়েকবার ফোন করে টাকার কথা বলেছে। প্রত্যেক বারই ১ মিনিটের কম কথা বলেছে। ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এই ঘটনার পর তারা থানায় গেছেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জিডি করেছেন। তবে তিনি মামলা করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। ফরহাদ মজহারের স্ত্রী আরো জানান, সর্বশেষ সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তিনি ফোন করেন। ওই সময় তিনি বলেন, আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। আমি এখন রাস্তায় হাঁটছি।
এদিকে পৌনে তিনটার দিকে ডিবি পুলিশ ফরহাদ মজহারকে আদালত পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পরে তাকে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মো. আহসান হাবীবের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত ১৬৪ ধারায় ভিকটিম ও সাক্ষী হিসেবে ফরহাদ মজহারের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এরপর ৫টা ৪১ মিনিটে তাকে এজলাসে হাজির করা হয়। এজলাসে ফরহাদ মজহারের পক্ষে এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া আদালতের কাছে অপহরণ মামলার এজাহার পড়ে শোনানোর আবেদন জানান। তখন বিচারক অপহরণ ও মামলা দায়েরের কথা উল্লেখ করে নথি সংগ্রহ করে পড়ে নিতে বলেন। এরপর নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেয়ার জন্য ফরহাদ মজহার নিজেই আদালতের কাছে আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে ১০ হাজার টাকা বন্ডে তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
উদ্ধার হওয়া ব্যাগ নিয়ে রহস্য: এদিকে উদ্ধার করার পর সোমবার রাত ১টা ২০ মিনিটে খুলনার ফুলতলা থানায় সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানিয়েছিলেন, উদ্ধারের সময় ফরহাদ মজহারের কাছে একটি ব্যাগ ছিল। তাতে মোবাইলফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে। ব্যাগ দেখে বোঝা যায় যে, তিনি স্বেচ্ছায় ভ্রমণে এসেছেন। তবে এই ব্যাগ উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। তার স্ত্রী ফরিদা আখতার ও মেয়ে সম্তলি হক বলেছেন, ভোরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার কাছে কোনো ব্যাগ ছিল না। ব্যাগ প্রসঙ্গে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার বলেন, ব্যাগ সঙ্গে নিয়েছেন কিনা তা তো জানি না। কিন্তু উনি প্রায়ই একটা ব্যাগ সঙ্গে রাখেন। যার মধ্যে পড়ার জন্য বই ও ওষুধ থাকে। তবে তার কাছে যেমন ব্যাগ দেখা গেছে তেমন ব্যাগ তিনি ব্যবহার করেন না। ফরিদা আখতার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ ব্যাগ কোথা থেকে আসলো? তিনি আরো বলেন, উনি ব্লাড প্রেসারের রোগী। ওষুধ না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর আমার মনে হচ্ছে উনি ঠিকমতো খাননি। সঙ্গে ওষুধ নেননি। ওনাকে দেখে খুব খারাপ লাগছে। আগে এমন দেখিনি। ফরহাদ মজহারের মেয়ে বলেন, আপনারা তো বাড়ি থেকে বের হওয়ার ফুটেজ দেখেছেন। তার কাছে তো কোনো ব্যাগ ছিল না। এখন ব্যাগ আসলো কিভাবে?