গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে তুফান-মতিনের এলাকা চকসূত্রাপুর, নামাজগড়, বাদুড়তলা এলাকায়। চলছে সুনসান নীরবতা। সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনায় তুফান এবং তার সহযোগীরা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্বস্তির হাওয়া বইছে সেখানে। তবে সেই স্বস্তির নিশ্বাস সেখানকার মানুষ প্রকাশ্যে নিতে পারছে না। অজানা এক আতঙ্ক আর ভয় তাদের তাড়া করে ফিরছে।
এ ঘটনায় বেশি খুশি শহরের ২০ হাজার গরিব অটোরিকশাচালকরা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাদের আর চাঁদা দিতে হচ্ছে না। তুফানের লাঠি বাহিনীও উধাও। কোথাও এদের আর দেখা যাচ্ছে না।
কথা হয় নামাজগড় এলাকার রিকশাচালক সোলায়মান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, জমি বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকায় একটা অটোরিকশা কিনেছি। আমি জানতাম না, সেই রিকশা রাস্তায় নামাতে কাউকে ৩০০০ টাকা দিতে হবে। মাস তিনেক আগের কথা, চারমাথা থেকে বাদুরতলা হয়ে সাতমাথায় যাওয়ার জন্য রিকশায় দুজন প্যাসেঞ্জার ওঠে। আমি বাদুরতলা পর্যন্ত আসতেই লাঠি হাতে লাল সার্ট পরা একজন রিকশা থামিয়ে কাগজ দেখতে চায়। আমি তাদের বলি কিসের কাগজ আপনাকে দেখাবো। সেই কথা বলতেই হাতের লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করলো। তারপর বললো, তুই ভাইরে চিনিস না রিকশা চালাতে শহরে এসছিস? রিকশায় থাকা দুই ভদ্রলোক হতভম্ব হলেও গুন্ডা বাহিনীর চেহারা সুরত দেখে কোনো কিছু না বলে রিকশা থেকে নেমে যায়। তার পর রিকশাসহ সোলায়মানকে ধরে নিয়ে যায়। তখন বেলা ১২টা। তুফানের সূত্রাপুর চামড়াগুদাম লেনের বাড়িতে নিয়ে যায় তাকে। রিকশায় তালা মেরে সোলায়মানকে বলে ভাই এখন ঘুমায়। কথা না বলে সোজা কোথায় যাবি যা। রাত ৯টার পরে আসল ফি ৩০০০ এবং জরিমানা ২০০০ সহ ৫০০০ টাকা নিয়ে আসিস। যদি ৩ দিনের মধ্যে না আসিস তাহলে তোর রিকশার আর পাবি না। সোলায়মান জানায়, আমি তাকে অনেক অনুরোধ করেছি যে, আমার কাছে এত টাকা নেই। আমাকে এক মাস সময় দেন। তাকে রাজি করানো যায়নি। সোলায়মান আবারো গ্রামের বাড়ি ফিরে যায়। সুদের ওপর ৫০০০ টাকা নিয়ে দুই দিন পরে হাজির হয় তুফানের দরবারে। তুফান টাকা বুঝে পাওয়ার পর হাতে একটা নেমপ্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলে রিক্সার পেছনে লাগাস, তাহলে কেউ কিছু বলবে না।
এ রকম শত শত সোলায়মান এখন খুশি। তার পরে আতঙ্ক কাটছে কারোই। কারণ, তুফান আবারো বেরিয়ে আসবে না- এর গ্যারান্টি কি? আবার স্বমূর্তিতে ফিরে আসবেন এর নিশ্চয়তা কি? অনেকেই বলছে, এবার বের হয়ে আসলে যারা তাকে নিয়ে লেখালেখি করছে তাদের আগে শায়েস্তা করবে।
দুদক মাঠে: হঠাৎ করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া মতিন-তুফানকে নিয়ে বগুড়ার দুদক এত দিন কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। সাম্প্রতিক ধর্ষণের ওই ঘটনার পর থেকে দুদকের একটি টিম সম্পদের তথ্য নেয়ার জন্য মাঠে নামার কথা শোনা যাচ্ছে। বগুড়া দুদক কার্যালয় থেকে এখনো এই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
ধর্ষণের আলমত মিলেছে পরীক্ষায়: বগুড়ায় তুফান কর্তৃক ধর্ষণের শিকার কিশোরী মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ডাক্তারদের ওই রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। সেসঙ্গে ডাক্তাররা বলেছেন মেয়েটি নাবালিকা। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কেএম সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সোমবার মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। চলমান মামলাটির তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার হাতে ইতিমধ্যেই ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন পৌঁছেছে।
বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ রিপোর্টটি হাতে পাওয়ার খবর নিশ্চিত করে জানান, ‘চিকিৎসকদের দেয়া প্রতিবেদনে মেয়েটিকে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক নয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া: বগুড়ায় কিশোরী ধর্ষণ ও মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়ার ঘটনায় মুখ খুলেছেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মমতাজ উদ্দিন। তিনি বগুড়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে মমতাজ উদ্দিন বলেন, সংগঠন করা মানে অপরাধ করার লাইসেন্স নয়। সহযোগী সংগঠনসহ ভূঁইফোড় কিছু সংগঠনের কারণে আওয়ামী লীগের দুর্নাম হচ্ছে। সহযোগী সংগঠনগুলোর আলাদা গঠনতন্ত্র থাকায় আওয়ামী লীগ তাদের কাজে কখনই হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার রাখে না। তার পরও বগুড়ায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বারবার সাবধান করেছি। ডেকে নিয়ে বুঝিয়েছি। অনেক সময় কড়া ভাষায় সমালোচনা এবং সঠিক পথে আসার আহ্বান জানিয়েছি। কেউ শুনেছে, কেউ শোনেনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেক সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বাসায় দাওয়াত খান। তাদের বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যার ফলে আমাদের অনেকে তোয়াক্কাই করে না।
তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যক্তির কারণে আওয়ামী লীগ দুর্নামের অংশীদার হবে না। শুধু তুফান সরকার অথবা মতিন সরকার নয়; যারা এদের স্রষ্টা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুলে মমতাজ উদ্দিন বলেন, বগুড়ায় আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে বারবার বগুড়ার যানজট, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, জুয়া ও মাদকের ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছি। বগুড়া শহরে মাত্র ৫ হাজার সিএনজির লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে ২০ থেকে ২৫ হাজার লাইসেন্সবিহীন সিএনজি চলছে। সিএনজি স্ট্যান্ডগুলো বগুড়া শহরে যানজটের মূল কারণ। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি প্রশাসনের উদ্দেশ্যে বলেন, এসব অনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এসব ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।