বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মিয়ানমারের। তবে সে পরিকল্পনা অনুযায়ী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগতে পারে প্রায় ১০ বছর। বুধবার জাপানের নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে। মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী অং সান সুচি ১৯শে সেপ্টেম্বর ঘোষণা দিয়েছিলেন তার দেশ বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রস্তুত। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রাথমিক প্রস্তুতি এটি। তবে ঘোষণা দেয়া হলেও এ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখনো দেখা যায়নি। তার ওপর বাংলাদেশ সবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি যৌথ দল গঠন করতে সম্মত হয়েছে। উইন মিয়াত আয়ে জানান, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার জন্য দুই দেশকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। মিয়াত আয়ে জানান, পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত দল অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে তাদের দ্বিতীয় বৈঠকে বসবে। তিনি বলেন, আমরা যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারি তাহলে আমরা সামনের মাস থেকে কাজ শুরু করতে পারবো। এটা কঠিন নয়।
ধীরগতির পরিকল্পনা
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে ঠিক কিভাবে এ প্রক্রিয়া শুরু হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছে দু’দেশই। আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থার (আইওএম) দেয়া তথ্য অনুসারে, ২৫শে আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। তবে উইন মেয়াত আয়ে বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কত তা আমরা জানি না। তবে যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে আসতে ইচ্ছুক এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে মিয়ানমারের সাবেক বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে তাদের ফিরে আসার অনুমোদন দেয়া হবে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারে যে হারে রোহিঙ্গা নেবে তা একটি উদ্বেগের বিষয়। উইন মেয়াত আয়ের ভাষ্যমতে, মিয়ানমার দিন প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ জন রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার চিন্তা করছে। এই গতিতে পুরো প্রক্রিয়া সমপন্ন হতে কমপক্ষে প্রায় এক দশক সময় লাগবে। বাংলাদেশ এমন প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা শিবিরে অবিরতভাবে ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বসতি স্থাপনের সুযোগ দেয়া হলে তারা স্থানীয়দের অধীনে কম মজুরিতে কাজ শুরু করবে।
দলিল সংক্রান্ত ঝামেলা
নিক্কেই রিভিউকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উইন মেয়াত আয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তিনটি প্রধান শর্ত পূরণের কথা উল্লেখ করেন। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অবশ্যই স্বেচ্ছাকৃত হতে হবে। কোনো রোহিঙ্গা যদি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় তাহলে তার কাছে থাকা তার পরিচয় সংক্রান্ত নথিপত্রের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের কাছে থাকা নথিপত্রের মিল থাকতে হবে। আর যেসব রোহিঙ্গা তাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গেছেন, তাদেরকে বাংলাদেশের কোনো আদালত থেকে একটি অনুমোদন নিয়ে আসতে হবে। যারা তাদের পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলেছেন তাদেরকেও ফিরিয়ে নেয়া হবে। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে তাদের সাবেক নাম, পিতামাতার নাম ও বাসস্থান সমপর্কিত তথ্য প্রদান করতে হবে। যদি মিয়ানমার সরকারের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে ওই তথ্যের মিল থাকে তাহলেই কেবল তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। যারা ফেরত যেতে ইচ্ছুক তাদেরকে সীমান্তের চেকপয়েন্টে একদিন থেকে দেড় দিন সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। এসময়ের মধ্যে তাদের পরিচয় সংক্রান্ত কাগজপত্র বারবার চেক করা হবে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদেরকে তাদের বাড়িতে যেতে দেয়া হবে- যদি সে বাড়ি এখনো টিকে থাকে। যেসব রোহিঙ্গার গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদেরকে রাখাইন রাজ্যের একটি অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান করতে হবে- যতদিন না মিয়ানমার সরকার তাদের বাড়িঘর আবার নির্মাণ করে দেয়। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার পথে এই জটিল যাচাইকরণ প্রক্রিয়া একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল।
পদক্ষেপ গ্রহণে অনিচ্ছা
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন। তবে উইন মেয়াত এ ধরনের সকল অভিযোগ জোর গলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এ ধরনের নির্যাতনকারীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। এমনকি সামরিক বাহিনীর সদস্যও যদি এমন নির্যাতন চালায় তাহলে তাকেও শাস্তি দেয়া হবে। তবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা, তিনি জানিয়েছেন যে, এসব নির্যাতনকারীদের শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। আর এসব মন্ত্রণালয়ের নেতাদের প্রত্যেকেই মিয়ানমার সেনাপ্রধান মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। তাই প্রশ্ন জাগে এ বিষয়ে কোনো তদন্ত আদতে নিরপেক্ষ হবে কি-না। এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমারে সহায়তা প্রদান করার জন্য প্রবেশাধিকার চাচ্ছে। তবে ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে এমন প্রবেশাধিকার দেয়া হচ্ছে না বলে জানান আয়ে। উদাহরণ হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা রেডক্রসের এক ট্রাকের ওপর চালানো হামলাকে দেখান। তিনি বলেন, স্থানীয় বৌদ্ধরা মানবাধিকার সংস্থাদের এসব কার্যক্রম সহজভাবে গ্রহণ করবে না।
এদিকে আগস্ট মাসে জাতিসংঘের সাবেক মহাপরিচালক কফি আনান নেতৃত্বাধীন কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য ৮৮টি সুপারিশ উল্লেখ করে। আর এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব উইন মেয়াত আয়েরই। তবে তিনি এমনটি করতে ইচ্ছুক নন। তিনি বলেন, এগুলো শুধুমাত্র সুপারিশ। আমাদের সবগুলো (সুপারিশ) বাস্তবায়ন না করলেও চলবে।