বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী যুবরাজ আলওয়ালিদ বিন তালাল সহ আরো কমপক্ষে ১০ জন যুবরাজ, চারজন মন্ত্রী ও সাবেক ১০ জন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে সোমবার। সৌদি আরবের আল আরাবিয়া টেলিভিশনে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে শনিবার রাতে। যুবরাজ আলওয়ালিদকে গ্রেপ্তারের খবরে সৌদি আরব তো বটেই বি,েশ্বর বড় বড় আর্থিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে। দুর্নীতির অভিযোগে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আল আরাবিয়া বলেছে, যেকারো বিরুদ্ধে তদন্ত, গ্রেপ্তার, বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দের অধিকার আছে সৌদি আরবের দুর্নীতি বিরোধী কমিটির। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স, অনলাইন নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে ওইসব যুবরাজ ও মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।দুর্নীতি বিরোধী এই কমিটির প্রধান হলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। শনিবার রাজকীয় এক ডিক্রি জারি করে গঠন করা হয় এই কমিটি। উল্লেখ্য, গ্রেপ্তার করা যুবরাজ আলওয়ালিদ বিন তালালের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হলো কিংডম হোল্ডিং। এ ছাড়া বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নিউজ করপোরেশন, সিটি গ্রুপ, টুইটার ও অনেক সুখ্যাত কোম্পানিতে রয়েছে তার শেয়ার। এ ছাড়া যুবরাজ আলওয়ালিদ আরব দুনিয়াজুড়ে স্যাটেলাইট টেলিভিশন নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সর্বশেষ এই গ্রেপ্তারির মাধ্যমে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতাকে আরো সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছেন। প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান হলেন বর্তমান বাদশা সালমানের প্রিয় পুত্র ও শীর্ষ উপদেষ্টা। ৩২ বছর বয়সী এই যুবরাজ এরই মধ্যে সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী, পররাষ্ট্র নীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পলিসি সহ বিভিন্ন বিষয়ে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করেছেন। ফলে মাঝে মাঝেই কান-খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, এ কারণে রাজপরিবারে বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, শনিবার ওই গ্রেপ্তার অভিযান চালানোর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে দুর্নীতি বিরোধী শক্তিশালী নতুন কমিটির ডিক্রি জারি করেছেন বাদশা সালমান। ওই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ক্রাউন প্রিন্স। ওদিকে রিয়াদে রাজপরিবারের জন্য প্রধানতম আকর্ষণ দ্য রিজ কার্লটন হোটেল। শনিবার তা ফাঁকা করে ফেলা হয়। তখনই গুজব ডালপালা ছড়ায়। বলা হয়, ওই হোটেলটিতে রাখা হবে রাজপরিবারের এসব বন্দিকে। ওদিকে দেশ ছাড়তে না পারেন যাতে সে জন্য ব্যক্তিগত বিমানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আরো অনেককে এ অভিযানে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। ফলে ধনী ব্যবসায়ীরা যাতে তাতে সফল না হতে পারেন সেজন্য তাদের বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত মাসে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাতকার দিয়েছেন যুবরাজ আলওয়ালিদ। এতে তিনি সৌদি আরবে তথাকথিত গোপন মুদ্রা ও রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো’র শেয়ার প্রকাশ্যে বিক্রি করার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রকাশ্যে তাকে কথা কাটাকাটি করতে দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে নিউ ইয়র্কের প্লাজা হোটেলের নিয়ন্ত্রণ কিনে নিয়েছে বিনিয়োগকারীদের একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের একজন যুবরাজ আলওয়ালিদ। এ ছাড়া ট্রাম্পের কাছ থেকে একটি ব্যায়বহুল ইয়াট বা প্রমোদতরী কিনেছেন এই যুবরাজ। ২০১৫ সালে টুইটারে এক টুইটে ডনাল্ড ট্রাম্পকে তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী দল রিপাবলিকান পার্টির জন্যই কলঙ্কের নয়, একই সঙ্গে পুরো যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। এর জবাবে ট্রাম্প তাকে ছেড়ে কথা বলেন নি। তিনিও পাল্টা এক টুইট করেছেন। তিনি যুবরাজ আলওয়ালিদ তালালকে নির্বোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বলেন, নির্বোধ যুবরাজ আলওয়ালিদ তালাল তার পিতার অর্থ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। ওদিকে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের রয়েছে উষ্ণ সম্পর্ক। পারস্পরিক বোঝাপড়া। মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, তার এই দ্রুত উত্থানের কারণে সৌদি আরবের নাগরিকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করছেন। সৌদি আরব যেসব অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি তা চিহ্নিত করে সে মতো ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কৃতীত্ব দেয়া হচ্ছে তাকে। তিনি চেষ্টা করছেন দেশকে তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যদিকে অগ্রসর করাতে। তবে অন্যরা তাকে দেখছেন হঠকারী, ক্ষমতালিপ্সু ও অনভিজ্ঞ হিসেবে। বয়সে বড় এমন কাছের আত্মীয়-স্বজনকে পাশ কাটিয়ে তার ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। খবর পাওয়া গেছে, গত মাসে সৌদি আরব সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জামাই জারেড কুশনার ও হোয়াইট হাউজের কমপক্ষে আরো দু’জন সিনিয়র নেতা। ওই সময় তারা বৈঠক করেছেন। কিন্তু সেই বৈঠকের কথা তখন গোপন রাখা হয়। এখানে বলে রাখা ভাল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে যুবরাজ আলওয়ালিদ তালালের তিক্ত সম্পর্কের আগে তাকে প্রকাশ্যে তিরস্কার করেছিলেন নিউ ইয়র্কের মেয়র রুডলফ ডব্লিউ গিলিয়ানি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করেছিলেন যুবরাজ আলওয়ালিদ। এ কারণে নিউ ইয়র্কে ১১ই সেপ্টেম্বর বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার শিকার ব্যক্তিদের জন্য আল ওয়ালিদের দেয়া এক কোটি ডলারের অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মেয়র গিলিয়ানি। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, দৃশ্যত রাজপরিবারের মধ্যে আলওয়ালিদকে দেখা হয় বহিরাগত হিসেবে। বিপুল অর্থের মালিক ও শক্তিধর আল ওয়ালিদ শুধু রাজ পরিবারের সঙ্গে ভিন্নমতই পোষণ করেন এমন নয়, তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে অস্বাভাবিকভাবে খোলামেলা কথা বলেন। সৌদি আরব সম্প্রতি বলেছে, তারা নারীদেরকে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেবে। তবে এ ঘোষণা দেয়ার অনেক আগেই প্রকাশ্যে নারীদের এমন অধিকারে সমর্থন দিয়েছিলেন আল ওয়ালিদ। এ ছাড়া তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের চাকরি দিয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি ঘোষণা দেন, মারা যাওয়ার পর তার ৩২০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি দান করবেন দাতব্য সংস্থায়। তবে সেই অর্থ সৌদি আরবের দুর্নীতি বিরোধী কমিটি জব্দ করবে কিনা তা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্পষ্ট জানা যায় নি। উল্লেখ্য, সৌদি আররে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। নেই নিরপেক্ষ সরকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। নেই পার্লামেন্ট। আদালত। সেখানে কার্যকর রাজতন্ত্র। ফলে দুর্নীতির যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মূল্যায়ন করা, যাচাই বাছাই করা এক জটিল বিষয়। এখানে আরো বলে রাখা যায়, সৌদি আরবের জাতীয় গার্ড বিষয়ক মিনিস্টার ইন চার্জ যুবরাজ মুতাইব বিন আবদুল্লাহকে পদ থেকে বরখাস্ত করার দু’এক ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। যুবরাজ মুতাইব বিন আবদুল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করতেন সৌদি আরবের তিন বাহিনীকে। তবে শেষ পর্যন্ত তিন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্রাউন প্রিন্সের অধীনে রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত জানা যায় নি। ২০১৫ সালের মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণা দেন বাদশা সালমান। এ বছরের শুরুর দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধন পদ থেকে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে দেন বাদশা সালমান। এরপর তাকে গৃহবন্দি রাখা হয়। এরপর দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন ক্রাউন প্রিন্স।