সুপ্রাচীন কাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, বোম ইত্যাদি জাতিগুলি সিনলুন, চীন, আরাকান, ত্রিপুরা, বার্মা এবং অন্যান্য এলাকা থেকে আনুমানিক মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আবাস স্থাপন করেছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় প্রথমে আসেন কুকিরা। পরবর্তীতে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে আসেন আরাকানি গোত্রভুক্ত চাকমা ও মার্মা সম্প্রদায়।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়ি-বাঙালি, জাতি-উপজাতির পার্থক্য ভুলে যাওয়ার আহবান জানিয়ে রাঙ্গামাটির স্টেডিয়ামে নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২১ বছরের সংঘাত এবং রক্তক্ষরণের অবসান ঘটে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্য কোনো তৃতীয়পক্ষের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এই শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর থেকে বিগত ২০ বছরে এর বাস্তবায়নে সরকার বেশ আন্তরিকতার পরিচয় দেয়।
চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে শান্তিবাহিনীর প্রায় দু’হাজার সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তখন তাদের প্রত্যেককে সরকার ৫০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। এর ফলে অবসান হয় পাহাড়ে প্রায় দুই দশকের শান্তিবাহিনী-সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী বন্দুক যুদ্ধের। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর চুক্তিটি মন্ত্রিপরিষদে পাস হয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১০০ দিনের মধ্যে যে কাজগুলো সম্পন্ন করার কথা ছিল, এর অংশ হিসেবেই গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ১৯৯৮ সালের ৩, ৪ ও ৫ মে যথাক্রমে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন এবং ৬ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন পাস হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ মে অন্তবর্তীকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের আন্তরিকতা ও অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে শান্তিচুক্তির পর হতে এ যাবতকাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির সুফল হিসেবে আদিবাসী শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, তাদের দলের অন্যান্য সদস্য এবং পাহাড়ের সাধারণ মানুষ বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করছে।
বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের নীল-নকশা আঁকছে রাজা দেবাশীষ। যা চরম রাষ্ট্র দ্রোহীতার প্রকাশ। বাঙালিদের তিনি ডাকেন ‘সেটেলার’ বলে, যার অর্থ দখলদার। কথায় কথায় করেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। জুম্মাল্যান্ডে কথিত রাজা দেবাশীষ তার নিজস্ব একটি বাহিনী গঠন করেছে- যাদের রয়েছে নিজস্ব ইউনিফর্ম এবং আগ্নেয়াস্ত্র। রয়েছে নিজস্ব অবৈধ পতাকা। জুম্মাল্যান্ডকে স্বাধীন করার জন্য তারা আরো নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। নিরীহ আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে দলে ভিড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত দেবাশীষ হয়তো জানেন না, জুম্মাল্যান্ড একটি আলাদা স্বাধীন দেশ হলে তারা পাবেন না বাংলাদেশের কোনো সুযোগ সুবিধা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সড়ক পথ, আকাশ পথ, স্থল/জল বন্দর, উৎপাদিত ফসল, প্রযুক্তি, প্রশাসন সহ আরো অসংখ্য সুবিধা। মূলত, বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু উপজাতি দল যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছে, তা বয়ে আনবে অনিঃশেষ অকল্যাণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম কোথা থেকে যোগান দিবে তাদের স্বাস্থ্য বা শিক্ষার চাহিদা, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কার্যকলাপ? বস্তুত এ ধরনের দাবি ভিত্তিহীন।
সচেতন সম্প্রদায় এ ব্যাপারে সজাগ আছে। প্রাথমিকভাবে রাঙামাটি-বান্দরবান-খাগড়াছড়ি এই ৩টি প্রদেশ নিয়েই গঠন করার চেষ্টা এই জুম্মাল্যান্ড। আর এসবের মূলে আছেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়! যার বাবা ত্রিদিব রায় কেবল একজন রাজাকার নয়, ছিলেন পাকিস্তানের হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদেও।
সরকার চাকরি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে আদিবাসীদের জন্য ৫ শতাংশ রিজার্ভ কোটার ব্যবস্থা করেছে, তাদেরকে সরকারি ট্যাক্সের আওতামুক্ত রেখেছে। এ সবই করা হয়েছে তাদের আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে। সরকার প্রদত্ত এ সকল সুবিধা ভোগ করে শিক্ষা, চাকরি এবং জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের ব্যাপক উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। দিন দিন এ অবস্থার আরো উন্নতি হবে। সরকার এসবই করছে, পাহাড় এবং সমতলের মধ্যে মেলবন্ধন গড়তে। শান্তিচুক্তির সুফল ভোগ করে উপজাতিদের বর্তমান জীবন যাত্রার মান, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রসরতা প্রভৃতি বিবেচনা করে এ কথা বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন আর বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া কোনো জনপদ নয়।
বাংলাদেশ কেবল পাহাড়ি বা বাঙালি কারো একার রাষ্ট্র নয়; এখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতালসহ সব জনগোষ্ঠীই সমমর্যাদার নাগরিক। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাই পাহাড়ের প্রাণ। এদেশের কোনো প্রগতিই আদিবাসীদের বাদ দিয়ে বিবেচনা করা হয় না। এই উপলব্ধিই বাংলাদেশের সংহতি ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পাহাড়ি বাঙালির সম্পর্কের জটিলতা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আগে একে অপরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেবহাল হতে হবে।