নতুন প্রজন্ম একাত্তর দেখেনি, স্বাধীনতা অর্জন দেখেনি, কিন্তু এ অর্জনকে জেনে নিয়েছে ইতিহাস থেকে। আর স্বাধীনতার ইতিহাস মানেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাস্তবায়নের ইতিহাস। তাই স্বাধীনতা না দেখলেও বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনলে উপলব্ধি করা যায়, তা কেমন ছিল। কেননা এ ভাষণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়। এটি সর্বকালের, সকল সময়ের।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তিই রচনা করেনি, এ ভাষণ ছিল বাঙালি জাতির আদর্শ ও চেতনারও মূল ভিত।
একাত্তরের ৭ই মার্চে মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি দেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই এটি কালজয়ী এক ঐতিহাসিক ভাষণ। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই একমাত্র ভাষণ, যা কিনা একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর হাতে না ছিলো কোনো মসনদ, না ছিলো রাজ্যভাণ্ডার, সৈন্য-সামান্ত বা গোলাবারুদ। তবুও কী দুর্লভ বীরত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন…
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’
এই মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আহবানের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শাষকদের শোষণ ও নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা ও তা অর্জনে বাঙালি জাতির সক্ষমতার কথাও মনে করিয়ে দিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিলেন।
ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন, যা বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি।
তিনি তাতে তুলে ধরেছেন, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, যা নিরীহ বাঙালির ওপর অত্যাচারের, রক্তের ইতিহাস। সেই ইতিহাসে রয়েছে বাঙালি নর-নারী আর্তনাদের কথা। দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে কালে-কালে রাজপথ রঞ্জিতের ইতিহাস।
এ ভাষণে এসেছে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের গৌরবের কথা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেও বাঙালি জাতির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রহসনের, ১৯৫৮ সালের মার্শাল ‘ল’, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার কথা। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে, ইয়াহিয়া খানের সরকার বাঙালির সঙ্গে শাসনতন্ত্র-গণতন্ত্র দেয়ার কথা বলে তামাশার যে রঙ্গমঞ্চ সৃষ্টি করেছিল; তার আদি-অন্ত তুলে ধরেছেন তিনি।
একাত্তরের ১লা মার্চ অ্যাসেম্বলি বন্ধ করার প্রতিবাদে বাংলার জনগণ যে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করেছিলো, শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ায় স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন সেই ইতিহাসের পাশাপাশি আমরা বঙ্গবন্ধুর গলায় দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে শুনেছি, ‘কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের ওপর চালানো হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখন ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’
বঙ্গবন্ধুকে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে শুনি, ‘ইয়াহিয়া খান, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, কীভাবে আমার গরিবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’
জীবনের নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও বাঙালি স্বাধীনতার সংগ্রামকে অর্জন করার জন্য যত রকমের আত্মত্যাগের প্রয়োজন; বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি ধাপে তার প্রস্তুতির কোনো অন্ত ছিল না। সে কারণেই মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়েই পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল বলেই ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলার পরেও কাল-বিলম্ব না করে সাথে সাথেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিল পুরো বাঙালি জাতি। ৭ই মার্চের ভাষণে উজ্জীবিত বাঙালি জাতি তাই ৯ মাসের যুদ্ধেই পেয়েছিল স্বপ্নের স্বাধীনতা।