মিরপুর ১২ নম্বর এলাকার ইলিয়াস মোল্লাহ বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের এক সপ্তাহ পার হতে চললেও প্রতিশ্রুত সরকারি সাহায্য হাতে পাননি ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। এখনো পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়েও ত্রাণ বিতরণের বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ অবস্থায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা তাড়া করে ফিরছে বস্তির বাসিন্দাদের।
১১ মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত এই অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় বস্তির পাঁচ হাজারের মতো ঘর। ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিট কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকাণ্ড নিঃস্ব করে দিয়ে যায় ২৫ হাজার বাসিন্দাকে। অনেকের সারা জীবনের অর্জিত সঞ্চয় মুহূর্তে ছাই হয়ে যায় চোখের সামনে।
অগ্নিকাণ্ডের পর ১৩ মার্চ বস্তি এলাকা পরিদর্শনে যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য সরকার ১০০ টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে গতকাল রোববার পর্যন্ত বস্তিবাসীদের হাতে সাহায্যের চাল কিংবা টাকা পৌঁছায়নি। এ বিষয়ে ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি সাহায্য কাল (সোমবার) পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।’ তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত তৈরি না হওয়াতে এই বিলম্ব। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহম্মদ বলেন, ‘অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রতিবেদন তৈরিতে দেরি হচ্ছে।’
গতকাল রোববার পোড়া বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপ পাশে সরিয়ে ওপরে পলিথিন, ত্রিপল কিংবা টিন দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ নতুন ঘর তোলার কাজ শুরু করেছেন। বস্তির বাতাসে এখনো আগুনে পোড়া বাঁশ-কাঠের গন্ধ। এর সঙ্গে খোলা পায়খানার দুর্গন্ধ মিশে তৈরি হয়েছে দম বন্ধ করা পরিবেশ। এর মধ্যেই চলছে প্রতিদিনের জীবন। ঘরহারা মানুষের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে ইলিয়াস মোল্লাহর মালিকানাধীন একটি বহুতল ভবনে।
বস্তির সবচেয়ে বড় মুদি দোকানটির মালিক ছিলেন রুবেল সরদার। দোকানে দুটি ফ্রিজসহ তিন লাখ টাকার মালামাল ছিল। এখন তিনি একপ্রকার নিঃস্ব। তিনি বলেন, ‘বাড়ি থেইক্যা রাগ কইর্যা ঢাকায় আইছিলাম। রিকশা চালায়া, রাজমিস্ত্রির জোগালি খাইটা ছোট একটা দোকান দিছিলাম ১৫ বছরের চেষ্টায়। আমার দাঁড় করানো ব্যবসাটা ছাই হয়্যা গেল।’ ধার করা টাকায় দুটি কেটলি আর কয়েকটি নতুন কাপ কিনে পোড়া ঘরের ওপর নতুন করে চায়ের দোকান সাজিয়েছেন রুবেল।
বস্তির বাসিন্দারা বলছেন, এই মুহূর্তে দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য তাঁদের চিন্তা করতে হচ্ছে না। সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর বাড়িতে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষের রান্না হচ্ছে। তবে তাঁদের এককালীন সাহায্য বড় প্রয়োজন। যাতে ঘুরে দাঁড়ানোর বন্দোবস্তটুকু হয়।
নারগিস আক্তার নামের এক নারী অসহায় কণ্ঠে বলেন, ‘সরকার নাই, এনজিও নাই। থালা নাই, বাটি নাই। পলিথিনে ভাত আইন্যা পলিথিনেই কইরা খাইতে হয়। এক কাপড়ে জানডা হাতে নিয়া বাইর হইছিলাম। সেই কাপড়েই আছি।’
খাদিজা বেগম নামের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী বলেন, ‘কোলের বাচ্চাডির পাতলা পায়খানা, জ্বর। হাতে ওষুধ কিননের ট্যাকাও নাই।’
খাদিজা বেগমের মতো এমন অন্তত পাঁচজন নারী তাঁদের বাচ্চাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা বলেছেন। তাঁরা বলছেন, রাতে খোলা জায়গায় ঘুমানো, খাওয়ার অনিয়ম আর সেদিনের আতঙ্ক-সবকিছু মিলিয়ে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
পোশাককর্মী স্মৃতি আক্তার ৬০ হাজার টাকা খরচ করে বস্তিতে দুটি ঘর কিনেছিলেন এক বছর আগে। ঘরের সঙ্গে বেতনের ৮ হাজার টাকাও পুড়ে গেছে। এ অবস্থায় অসুস্থ স্বামী আর এক বাচ্চাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। নতুন করে ঘর তোলার টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছেন।