পর পর কয়েকটি নৃশংস ধর্ষণের ঘটনায় আবার নাড়া দিয়েছে ভারতকে। এর ফলে যৌন সহিংসতা আবারো জাতীয় একটি এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ১৬ ও ৮ বছর বয়সী দুটি বালিকার ওপর যৌন সহিংসতা যেভাবে জনমানুষের মনে নাড়া দিয়েছে তেমনটা দেখা দিয়েছিল ২০১২ সালে দিল্লিতে। তখন মেডিকেল পড়–য়া এক ছাত্রীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে পরে রাস্তায় ফেলে যায় নরপিশাচরা। এর ফলে মারা যান ওই ধর্ষিতা। ঘটনাটি ৬ বছর আগের হলেও আবারো ধর্ষণের কঠোর শাস্তির দাবি উঠেছে। এর ফলে মন্ত্রীপরিষদ ১২ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে নির্বাহী আদেশ পাস করে।এই আদেশটি পার্লামেন্টে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পার্লামেন্ট অনুমোদন দিলেই তা আইনে পরিণত হবে। ভারত ১৩০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ। সেখানে মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগই হলেন নারী। এই নারীরা আসলে কি চান? রাজধানী নয়া দিল্লিতে এ নিয়ে পাঁচজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন সিএনএনের সাংবাদিকরা। এ বিষয়ে তারা ওই ৫ নারীর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছেন। ভারতে নারীরা নিজেকে কতটা নিরাপদ? এমন প্রশ্নে সাংবাদিকতার ছাত্রী অঙ্কিতা ওয়াধা (২১) বলেছেন, ভারতে আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করি না। প্রতিটি মুহূর্তে কিছু না কিছু ঘটে যাচ্ছে। সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ নয়। তবে সেটা হলো যৌন নির্যাতন বা বলাৎকারের ঘটনা। এগুলো ঘটাচ্ছে পুরুষরা। একজন যুবতী যখন ছোটখাট পোশাক পরে বাইরে বের হচ্ছেন তখন অন্যরা তার পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করছে। আমার মনে হয় নিজেকে অনিরাপদ ভাবার এটাই মৌলিক সমস্যা। নারীদের ক্ষার জন্য ভারত সরকারের কি করা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে অঙ্কিতা বলেন, প্রয়োজন দ্রুত বিচার। আমার মনে হয় এটাই এখন প্রধান বিষয়। সাম্প্রতিক ধর্ষণ ঘটনা নিয়ে বিশ্বে যেভাবে রিপোর্ট কভার করা হয়েছে সেক্ষেত্রে বিশ্ব ভারতের নারীদের কিভাবে দেখছে? এ প্রশ্নের জবাবে অঙ্কিতা বলেন, যখন এমন ঘটনা ঘটে তখন পুরো দেশই একটি ধর্ষণের দেশে পরিণত হয়। যারা ভারত সফরে আসেন তাদের সঙ্গে থাকা নারীদেরকে যথাযথ পোশাক পরে চলতে নির্দেশনা দেয়া হয়। তাদেরকে এদিক ওদিক না তাকাতে বলা হয়। আমার মনে হয় এটা দুর্ভাগ্যজনক। লক্ষীনগর বস্তিতে বসবাস করেন একটি স্কুলে সামাজিক কাজে নিযুক্ত কিশওয়ার জাহান (৬০)। আমি এই বস্তিতেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করি। কারণ এখানে অন্ততপক্ষে একজন আরেকজনকে চিনি। নারীরা নিরাপদ নন। কারণ, অপরাধ অনেক বেড়ে গেছে। এতটাই এসব অপরাধ বেড়ে গেছে যে নির্যাতিতদের কথা শোনাও হয় না। মোদি সরকারের সময়ে কেউই নিরাপদ নন। যৌন সহিংসতা সম্পর্কে তিনি বলেন, অনেক দিন ধরে এসব অপরাধ ঘটছে। তবে এই সরকারের অধীনে এখন যেভাবে ঘটছে আগে কখনো এতটা হয় নি। প্রতিটি মানুষ আতঙ্কে আছে। হোক সে একজন যুবতী বা একজন বয়স্ক নারী। তারা একবার ঘর থেকে বের হলে আর নিরাপদ নন। যদি সব দেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আইন অনুসরণ করতো তাহলে কোনো অপরাধই থাকতো না। কিন্তু সেই আইন ভারতে প্রয়োগ করা হয় না। কারণ, ভারত একটি মুসলিম দেশ নয়। তিনি বলেন, খবরে দেখেছি বিজেপির একজন রাজনীতিক বলেছেন, ভারতের মতো এত বড় দেশে এমন দু’একটি ঘটনা (ধর্ষণ) ঘটতে পারে। এগুলোকে কোনো ইস্যু হিসেবে দেখা উচিত নয়। ওই এমপির প্রতি প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, যদি আপনার মেয়ে বা বোন বা নাতি, নাতনী এমন ঘটনার শিকার হয় তাহলে আপনার আত্মা কি বলবে? আপনারা আসলে অন্যের মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে মনে করেন না। তিনি বলেন দিল্লি, উত্তর প্রদেশ বা পুরো ভারতে ন্যায়বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। যুবতীরা জানেন না ভবিষ্যতে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে। যেসব মেয়ে এখনও ছোট এবং তারা যখন বড় হচ্ছে তাদের সামনে এসব বিষয় আমাদেরকে তুলে ধরতে হবে। তারা ভাল ও মন্দের পার্থক্য বোঝে না। কি ঘটেছিল কাশ্মিরের আট বছর বয়সী বালিকার। সে যা-ই করে থাকুক বা যা-ই হোক শেষ পর্যন্ত সে তো একটি মানুষের মেয়ে। তার কথা ভাবতেই আমার কান্নায় বুক ভেঙে যায়। দিল্লি ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা আকৃতি কোলি (২৯)। তিনি বলেন, বিষয়টি হলো আমি কেমন অনুভব করি। আমি এখন পর্যন্ত কোনো বাজে অনুভূতি পাই নি। আমি মেট্রোতে করে চলাচল করি। এটা তো নিরাপদ। আমার কর্মক্ষেত্র পরিচ্ছন্ন। জম্মু-কাশ্মিরে ৮ বছর বয়সী শিশুটির সঙ্গে যা করা হয়েছে তা নিকৃষ্ঠ। অন্যদের তুলনায় ভারতীয় আইন যথেষ্ট কড়াকড়ি নয়। এটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। এ জন্য অনেক কিছু করতে হবে এবং অভিযুক্তদের পূর্ণাঙ্গ শাস্তি দিতে হবে। ভারতে নারীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, বাড়িতে আমি যেমন নিরাপদ কর্মক্ষেত্রেও তাই। আমার পিতামাতা লিখতে বা পড়তে জানেন না। আমার পরিবারে আমিই প্রথম গ্রাজুয়েট মেয়ে। আমার পিতা আমাকে পড়তে ও চাকরি করতে উৎসাহ দিয়েছেন। আমি মুসলিম সম্প্রদায়ের। যেখানে আমাদের বসবাস সেখানে আমিই একমাত্র কর্মজীবী নারী। আমার কোনো সমস্যা হয় না। এ বিষয়ে একটি দোকানের সহকারী রুকসানা দিলশাদ আলী (২৫) বলেন, ভারতে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের জন্য এক অসম্মানের বিষয়। সরকার বলছে, মেয়েদের বাঁচাও। তাদেরকে শিক্ষিত করো। রুকসানা দিলশাদ বলেন, আমাকে একটি জিনিস বলেন তো: মেয়েরা কোথায় নিরাপদ? অনেক কর্মজীবী যুবতী আছেন। তাদেরকে বাইরে যেতেই হয়। তারপর লোকজন বলাবলি করে যে, তারা মধ্যরাতে বাসায় ঘরে ফেরেন। আর সেটা ঘটছেও। কিন্তু ওই ছোট্ট মেয়েটির তাহলে কি দোষ? আমি তো একজন মা। ওই আট বছর বয়সী মেয়েটির পিতামাতার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। এমনটা তো আমার ক্ষেত্রেও কাল ঘটতে পারে। আমার ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। সে স্কুলে যায়। কিভাবে আমি তাকে নিরাপত্তা দেবো।