প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার ওপর দিয়ে শতাধিক ট্রেন আসা-যাওয়া করে। তবে ঢাকার রেলপথে চলতে গিয়ে ট্রেনের গতি কচ্ছপের গতিকেও হার মানায়। কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে যেতে হয় ট্রেনগুলোকে। ধীর গতির শুরুটা হয় ঢাকায়। একই অবস্থা হয় ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময়ও। গত দেড় বছরে রাজধানীতে ট্রেনের গতি ঘণ্টায় চার কিলোমিটার কমিয়ে আনা হয়েছে। ট্রেনের ধীর গতির কারণে রাজধানীতে যানজট বাড়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনাও বাড়ছে।
যে গতিতে রাজধানীতে চলছে ট্রেন
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ব্রড গেজ ও মিটার গেজ-দুই ধরনের রেললাইন রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এর দৈর্ঘ্য ৩৫ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলার উপযোগী করে ব্রড গেজ রেললাইন প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চললেও মিটার গেজ রেললাইনের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ঢাকার সীমানায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের গতি হয়ে যায় মন্থর। গত এক বছরে ঢাকায় ট্রেন চলাচলে গতি ঘণ্টায় চার কিলোমিটার কমিয়ে ৩৬ কিলোমিটার থেকে ৩২ কিলোমিটার করা হয়েছে।
বছর পাঁচেক আগে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো হতো। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর পর চার কিলোমিটার কমিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৬ কিলোমিটার একটি ট্রেনের গতি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ আরও চার কিলোমিটার গতি কমানো হয়। এখন কমলাপুর থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩২ কিলোমিটার গতি নিয়ে চালানো হয় ট্রেন। তেজগাঁও থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেললাইনে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা আছে ৬২ কিলোমিটার। টঙ্গী থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ট্রেন চলে ৭৫ কিলোমিটার গতিতে।
গতি কমার আট কারণ
আট কারণে ট্রেনে গতি কমিয়ে আনা হয়েছে বলে রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। এগুলো হলো রেললাইনের ওপর দিয়ে মানুষের চলাচল, দুপাশে অবৈধ স্থাপনা, রেললাইনের ওপর বাজার, রেললাইনের পাথর তুলে নেওয়া, পাথর নিক্ষেপ, ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগির ছাদে মানুষ দাঁড়ানো, অসংখ্য লেভেল ক্রসিং এবং রেললাইনে পানি জমে থাকা।
এর মধ্যে রেললাইনে পাথর না থাকার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লোকজনের চলাচল ও চুরির কারণে পাথর থাকছে না।
রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, একটি ট্রেনের সম্পূর্ণ ওজন চাকাগুলোর ওপর এসে পড়ে। সেখান থেকে এই ভার পড়ে রেললাইনের নিচে থাকা স্লিপারে। ট্রেনের সঙ্গে স্লিপারের ভারসাম্য রাখতে রেললাইনে পাথর বা ব্যালাসড্ বসানো হয়। কিন্তু ঢাকায় রেললাইনে এখন পাথর রাখা যাচ্ছে না। ট্রেনের গতিবেগের সঙ্গে কম্পনের বিষয়টিও জড়িত। এসব বিবেচনা করে রেললাইন নির্মাণ করা হয়। ট্রেন চলাচলে প্রতি বছর ১০ শতাংশ পাথর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তবে রাজধানীতে রেললাইনের ওপর ২৪ ঘণ্টাই মানুষের চলাচল করে। এতে রেললাইনের ওপর পাথর থাকছে না। অনেক জায়গায় পাথর চুরি হয়ে যায়। তাই পাথর না থাকায় গতি কমিয়ে চলছে ট্রেন।
ট্রেন চালকদের অভিযোগ, টঙ্গী, উত্তরা থেকে ঢাকায় স্বল্প সময়ে যাতায়াতের জন্য যাত্রীরা ট্রেনকে বেছে নেন। আন্তনগর বা ডেমো ট্রেনের কোনো বাছবিচার করা হয় না। উত্তরায় বিমানবন্দর স্টেশনে আসার পর হুড়মুড় করে লোকজন ট্রেনের ইঞ্জিন ও ছাদে উঠে যায়। বাধা দিলে অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে পাথর ছুড়ে মারে। তাই চালকেরা ধীর গতিতে ট্রেন চালাতে বাধ্য হন।
নাম প্রকাশ না শর্তে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের এক ট্রেন চালক প্রথম আলোকে বলেন, সোনার বাংলা, মহানগর গোধূলির গতিসীমা সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ঢাকায় এই গতিতে কখনোই ট্রেন চালানো সম্ভব হয় না। যেভাবে মানুষ হাঁটাচলা করে, তাতে দ্রুত গতিতে ট্রেন চলানো হলে রাজধানীতে মৃত্যুর সংখ্যা হিসেবে করে শেষ করা যাবে না।
রেললাইনে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকাও ট্রেনের গতি কমার বড় কারণ বলে ধরা হয়। ঢাকা শহরের রেললাইনের ওপর অসংখ্য মানুষ চলাচল করে। এ কারণে রেললাইনে বর্জ্য জমাট বাঁধে। তা ছাড়া রেললাইনের স্লিপারের পাশের জায়গাগুলোয় মাটি উঠে আসে। বৃষ্টি হলে তাই রেললাইনে পানি জমে যায়। ভারী বৃষ্টিতে রেললাইনের ওপর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। গেন্ডারিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ রুটে রেললাইনে এই অবস্থা বেশি দেখা যায়। জলাবদ্ধতার কারণে মাটি নরম হয়ে রেললাইন বসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর ফলে লাইনচ্যুতও হতে পারে ট্রেন। এ জন্য ট্রেনে গতি কমিয়ে আনা হয়।
ক্রসিং বেশি থাকার কারণেও ট্রেনের গতি কম। জানা গেছে, প্রতি এক কিলোমিটারের একটি করে রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে বৈধ ৩১ টি এবং অবৈধ অর্ধশত রেলক্রসিং রয়েছে। সব মিলিয়ে টঙ্গী রেলস্টেশনের পর ঢাকার ৭০টি রেলক্রসিং অতিক্রম করে একটি ট্রেনকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত যেতে হয়।
রেললাইনের ওপর চলে হাঁটাচলা, সাড়ে ৮ বছরে ১২০০ মৃত্যু
রাজধানীর রেললাইনের অধিকাংশ স্থানে অসংখ্য ঝুপড়ি ঘর, দোকানপাট রয়েছে। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর কাঁচাবাজার ও ভ্রাম্যমাণ হকাররা বসেন নানা ধরনের পণ্যের পসরা নিয়ে। এসব কারণে রেললাইন দিয়ে মানুষের হাঁটাচলা বেশি হয় বলে রেলপুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
তবে অনেকে কৌতূহলের কারণে রেললাইন দিয়ে হাঁটেন। অনেকে আবার রেললাইনের ওপর চলাচলে রোমাঞ্চিত হয়। এ কথা জানিয়ে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার অনেক জায়গায় রেললাইন সংলগ্ন হাঁটাচলার জন্য সড়ক রয়েছে। কিন্তু সড়কপথ ব্যবহার না করে রেললাইনকে চলাচলের জন্য বেছে নেন। তবে রেললাইনে সড়কপথের মতো ধীরে ধীরে পা ফেলে হাঁটা যায় না। একটি স্লিপার থেকে আরেকটি দূরত্ব আট ইঞ্চির মতো। তাই স্লিপারের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয়। স্লিপার ধরে হাঁটার সময় বেশির ভাগ সময়ই মানুষ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তখন ট্রেন আসার শব্দও শোনা যায় না। এমনকি হুইসেলও কাজে দেয় না। এর কারণে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব অংশ টাঙ্গাইল থকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনের দূরত্ব ১৭৬ কিলোমিটার। এই রেললাইনটি ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকার আওতায়। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৫ মে পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট বছরে এই রেললাইনে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৪৪৬ জন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা গেছে রাজধানী ঢাকায়।
ট্রেনে কাটা পড়া ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াকেই এসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রেলওয়ে পুলিশ। তাদের মতে, শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রেললাইনের দুপাশের অবৈধ দখলের কারণে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। এর মধ্যে ট্রেন দুর্ঘটনায় তুলনামূলক বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর কুড়িল, খিলক্ষেত, মহাখালী, ক্যান্টনমেন্ট, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, গেন্ডারিয়ার মতো জনবহুল এলাকাগুলোর রেললাইনে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত রাজধানীতে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে ১২০ টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫২ জন, আহত হয়েছেন ১০ জন। সেই হিসেবে ঢাকা মহানগরীতে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রতি মাসে গড়ে তিনজনের বেশি প্রাণ হারাচ্ছেন।
আইন মানছেন না কেউ-ই
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত আইনজীবী তানজিম আল ইসলামের ‘রেলওয়ের আইন মানতেই হবে’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করা হয়, ‘রেলওয়ে পরিচালনার জন্য দেশে আছে রেলওয়ে আইন ১৮৯০। এ আইনে রেল চলাচলের জন্য পূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেললাইনের আশপাশে যেন কোনো অবৈধ স্থাপনা না উঠতে পারে, এ জন্য কার্যকর আছে রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী রেলওয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। রয়েছে রেল পুলিশ (জিআরপি)।’
রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯ অনুযায়ী রেলওয়ের সম্পত্তি কেউ দখল করলে দায়ী ব্যক্তিকে সাত বছর পর্যন্ত জেল অথবা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ আইন অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় দায়ী ব্যক্তিকে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী এ বিচার চলবে। আবার দেওয়ানি কার্যবিধিও ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োগ হবে এবং অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতাও কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেললাইনের দুপাশে ১১ ফুট জায়গা খালি রাখার নিয়ম রয়েছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিবাগে ছোট ছোট গলির সঙ্গে পাঁচটি অবৈধ রেলক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। কুড়িল উড়াল সেতুর নিচেও নিয়ম না মেনে লোকজন চলাচল করে। মালিবাগ, মহাখালী, খিলক্ষেত ও কুড়িল এলাকায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। আমরা বিভিন্ন সময় সচেতনতার জন্য রেলস্টেশন ও আশপাশে মাইকিং করে থাকি। লিফলেটও বিতরণ করছি।’
উড়াল রেলপথ নির্মাণের পরামর্শ
রেলক্রসিংয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ট্রেনের গতি বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে ট্রেনের গতি বাড়াতে হবে। রেলপথকে আলাদা করতে হবে রাস্তা থেকে। আমরা এখন উড়াল সড়ক বানিয়ে রাস্তাকে আলাদা করছি। খিলগাঁওয়ে উড়াল সড়ক নির্মাণ করে দেখা যাচ্ছে, এখন নিচে যানজট থাকে, ওপরে থাকে। উড়াল সড়ক না বানিয়ে উড়াল রেলপথ তৈরি করতে হবে অনেকটা মেট্রোরেলের মতো’।
এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ট্রেনের গতি বাড়াতে ঢাকার কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রুট চার লেন করা হবে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে আগের দুই লেনের পাশে নতুন করে তৃতীয় ও চতুর্থ লেন স্থাপন করা হবে। এ জন্য রেললাইনের দুপাশে বস্তি, মার্কেটসহ সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে এই উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হবে। মানুষের চলাচল বন্ধে রেললাইনের দুপাশে বাউন্ডারি ওয়াল তৈরি করা হবে। তবে জনসাধারণের চলাচল সুবিধার জন্য ঢাকার রেললাইন সংলগ্ন ১০টি এলাকায় পদচারী সেতু (ফুটওভার ব্রিজ) রেলওয়ে নির্মাণ করবে বলে জানান তিনি।