বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরা। সম্প্রতি রাখাইনের কয়েকটি এলাকা ঘুরে, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁর এমনটা মনে হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে আইসিআরসি দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এই অভিমত দিয়েছেন।
মিয়ানমার সফরের পর পিটার মাউরা গত শনিবার বাংলাদেশ সফরে আসেন। এর মধ্যে তিনি কক্সবাজার গিয়ে রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে এসেছেন।
সীমান্তের দুই পাশ পরিদর্শনের পর পিটার মাউরা বলছেন, ‘মানুষের দুর্দশা লাঘবে আমরা মানবিক সংস্থাগুলোও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এত কিছুর পরও সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।’
পিটার মাউরা মনে করেন, একমাত্র মানবিক সহায়তা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান দিতে পারবে না। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য তাদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার বজায় রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার।
মিয়ানমার সফরের সময় পিটার মাউরা দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, এবং সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনেরাল মিন অং লায়েংয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।
রাখাইন সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আইসিআরসি প্রেসিডেন্ট বলেন, এখনো সেখানে বিশালসংখ্যক মানুষের ফেরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। প্রত্যাবাসনের জন্য শুধু মানবিক কার্যক্রম ও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়। আরও প্রয়োজন চলাফেরার স্বাধীনতা, মৌলিক সেবা পাওয়ার অধিকার, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাধীনতা, রাখাইনের বাজারে প্রবেশাধিকার এবং সর্বোপরি প্রত্যাবাসন-পরবর্তী নিরাপত্তাব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের আস্থা নিশ্চিতকল্পে কার্যকরী রাজনৈতিক পদক্ষেপ।
পিটার মাউরা বলেন, ‘আমি দাবি করি না যে যারা এখন রাখাইনে আছে, তারা খুব ভালো অবস্থানে আছে। এমনিতেই দূরবর্তী এলাকা, আর খুব কমই যেখানে মানুষ যায়। যে পথটা দিয়ে আমরা গাড়ি চালিয়ে গিয়েছি, সেখানে একসময় গ্রাম ছিল। সামান্য যা কিছু অবশিষ্ট আছে এখন, তার মধ্যে দ্রুত বেড়ে উঠছে গাছগাছালি। অন্যান্য জায়গায়, স্কুল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো খালি পড়ে আছে, পরিত্যক্ত। এক গ্রামে আমি গিয়েছি, সেখানে মূল জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও কম, নয় হাজারের মধ্যে মাত্র দুই হাজার মানুষ আছে। আমি মুসলিম, রাখাইন ও হিন্দু—সব সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মুখেই শুনেছি কীভাবে সামাজিক ব্যবস্থা আর স্থানীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। কীভাবে তারা দিনের পর দিন মানবিক সাহায্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এখনো সেখানে বিশালসংখ্যক মানুষের ফেরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।’
রাখাইনের পাশাপাশি কক্সবাজার সফরের পর তাঁর মনে হয়েছে, স্পষ্টতই সীমান্তের দুপাশের মানুষই ভুগছেন। লোকজনের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ আশ্রয়, ওষুধ, স্বাস্থ্য সেবা, পয়োনিষ্কাশন ও বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। জরুরি অবস্থায় কোনা সাহায্য ছাড়াই জীবন যাপনের জন্য উপার্জনের জন্য খুব সামান্য বিকল্পই রয়েছে।
পিটার মাউরা বলেন, ‘মানবিক সংকটের এই চিত্র দেখে আজকে আমার মনে হচ্ছে, ২০ বছর পরও কি ঠিক একই অবস্থা দেখতে হবে আমাদের? যেখানে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে এই ক্যাম্পে টিকে থাকতে কঠোর সংগ্রাম করতে থাকবে? যে শিশুগুলোকে আমি দেখেছি, তাদের ভবিষ্যৎ আরও ভালো ও নিশ্চিত হওয়া উচিত। জরুরি অবস্থায় ক্যাম্পে আরেক প্রজন্ম হিসেবে আটকে থাকা নয়। এটা যাতে না হয়, সে জন্য আমরা তাদের কাছে দায়বদ্ধ। মানবিক কারণেই একটা পরিবর্তন জরুরি প্রয়োজন। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই জটিল অবস্থার নিরসন করতে হবে এবং সমস্যার মূল কারণ নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আইসিআরসি তার দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী।’