নির্মাতা ফারুকীর খোলা চিঠি

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে খোলা চিঠি লিখেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

আজ শনিবার সকালে লেখা চিঠিতে ফারুকী বলেন, ‘প্রিয় মোস্তাফা জব্বার ভাই,কিশোর বিদ্রোহের এই অনন্যসাধারণ ব্যাপারটাকে ভিলিফাই করার চেষ্টা করবেন না, প্লিজ। মনে রাখবেন, এরা আপনাদের শত্রু না। এরাই আপনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধান সৈনিক হবে। মিরপুরে লাঠি হাতে যারা দাপিয়ে বেড়িয়েছে তাদের দিয়া জয় ভাইয়েরও কাজ হবে না, ববি ভাইয়েরও না। লাগবে এসব সোনার ছেলেমেয়েদেরই। আরো মনে রাখবেন, দুই হাজার আটে সাধারণভাবে তরুণরা আপনাদের পক্ষে ছিল বলেই আপনাদের পক্ষে জোয়ার আসছিল। ভাবেন এই ছেলেমেয়েরা পাঁচ-দশ বছর কোথায় যাবে। তখন এরা কত জরুরি হবে আপনাদের কাছে।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আমরা মেনে নিচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রেদওয়ান মুজিব তাদের সম্মানে হেঁটে অফিসে গেলেন। ডিএমপির মনির ভাই বললেন শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।

‘এখন হঠাৎ করে বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা ঘটনা, স্লোগান আর ভাষা নিয়া অহেতুক আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ছোট করার ব্যর্থচেষ্টা করবেন না। এতে আপনি, আমি, আমরা, আমাদের ভবিষ্যৎ সবাই ছোট হচ্ছি। গালি বা স্ট্রিট ল্যাংগুয়েজের নন্দন তত্ত্ব, সামাজিক ব্যাখ্যা এসবে না গিয়ে আপনাকে খেয়াল করিয়ে দিতে চাই এসব দুয়েকটা ঘটনা এই আন্দোলনের আসল চিত্র ছিল না। এত হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রাস্তায় এসেছে তাদের মধ্যে কত রকমের মানুষ থাকতে পারে। নব্বইয়ে ছিল না এই রকম অতি সামান্য বিচ্ছিন্ন উপাদান?’

চিঠিতে লেখা হয়, ‘আমি বরং সেসব নিয়ে কথা না বলে খেয়াল করাতে চাই এই আন্দোলন কত রাজনৈতিকভাবে সচেতন স্লোগান ব্যবহার করেছে । খেয়াল করিয়ে দিতে চাই, পুলিশ-ছাত্র গলাগলি করে কীভাবে দাঁড়িয়েছিল ফার্মগেটে, কি সুমধুর সুরে এরা জাতীয় সংগীত গেয়েছে, কি সুন্দরভাবে লাইসেন্স চেক করে থ্যাংক ইউ বলেছে, কোথাও কোথাও চকলেট দিয়েছে। খেয়াল করাতে চাই এদের বক্তব্যে এবং কণ্ঠে কতবার বঙ্গবন্ধুর কথা উঠে এসেছে রেফারেন্স হিসেবে। নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে এভাবে দেখেও কি আপনি আশাবাদী হন নাই? আমি তো ভীষণ হয়েছি।’

ফারুকী আরো বলেন, ‘এখন ওদের হাসিমুখে ঘরে ফিরতে দেন আর যে কাজ করার ওয়াদা করেছেন সেগুলোতে হাত দেন। তারপর আমরা সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে যাই সামনের দিকে।

এবার নিচে এই আন্দোলনের কিছু জনপ্রিয় স্লোগানের লিস্ট দিয়ে দিলাম যদি আপনি মিস করে থাকেন এই ভয়ে।’

‘১. হয়নি বলেই আর হবে না, আমরা বলি বাদ দে। লক্ষ তরুণ চেঁচিয়ে বলে পাপ সরাবো হাত দে।
২. যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ , যদি তুমি রুখে দাড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।
৩. জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হবে।
৪. পারলে মাথায় গুলি কর, তাহলে মেধা মারা যাবে, কিন্তু বুকে গুলি করিস না, এখানে বঙ্গবন্ধু ঘুমায়, বন্ধু জেগে গেলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
৫. আমরা নয় টাকায় এক জিবি চাই না ‘নিরাপদ সড়ক চাই’।
৬. চার কোটি শুক্রাণুর সাথে লড়াই করে জন্মেছি, চাকার তলায় পিষার জন্য নয়।
৭. পথ খুলবে বলেই রাস্তা আটকাই।
৮. শিক্ষকের বেতের বাড়ি নিষেধ যেই দেশে, পুলিশের হাতে লাঠি কেন সেই দেশে।
৯. আর নবারুন ভট্টাচার্যর কবিতাটা যেটার লাইন আমার হুবহু মনে পড়ছে না।
১০. টনক তুমি নড়বে কবে?
১১. ন্যায্য দাবির মিছিলে যে চোখ
সে চোখ জেগেছে জয়ে
মিছিল কখনো থামে না বুলেটে
স্লোগান থামে না ভয়ে।’

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না ওদের বয়সে আমি এই রকম গুছিয়ে বলতে পারতাম। মনে পড়ে মহল্লার সরু রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠলে জড়তায় সংকুচিত হয়ে থাকতাম। সেখানে মহাসড়কে নেমে এত গুছিয়ে একটা আন্দোলন তো অনেক দূরে কথা। আপনি কি পারতেন, প্রিয় জব্বার ভাই? আপনাকে ধন্যবাদ।’

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস প্রতিযোগিতা করে মিরপুর থেকে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে আসছিল। এ সময় ফ্লাইওভারের শেষ দিকে, রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল একদল শিক্ষার্থী। এর মধ্যে একটি বাস ফ্লাইওভার থেকে নেমেই দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আহত হয় বেশ কয়েকজন। নিহতরা হলো শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব।

ওই ঘটনার পর থেকেই বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে টানা কয়েক দিন। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবিতে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীসহ অনেক শিল্পী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *