রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বয়ে যাওয়া যন্ত্রণার বিধ্বংসী চিহ্নগুলো স্বচক্ষে দেখলো বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সিনিয়র সচিব মো. শহীদুল হকসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কয়েক জন সদস্য মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলের ওই এলাকা পরিদর্শন করেন গতকাল। সেখানে তারা বর্মী বর্বরতায় বাংলাদেশে
পালিয়ে আসা ৭ লাখ রোহিঙ্গার আদি বসবাসের স্থানসহ ওই এলাকার বিধ্বস্ত চিহ্নগুলো প্রত্যক্ষ করেন। রোহিঙ্গা ঢলের এক বছরের মাথায় তারা ঐ এলাকায় যাওয়ার সুযোগ পেলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের রাখাইনের মংডু টাউনশীপ এবং সীমান্ত এলাকায় নতুন করে তৈরি হতে থাকা বাড়িঘর এবং বসতিগুলো পরিদর্শনের কথা জানানো হয়।
ইয়াংগুনের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রচারিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় সীমান্তের জিরো লাইন বা শূন্য রেখায় আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ প্রান্ত থেকে খাদ্য, পানীয়সহ যেকোনো ধরনের মানবিক সহায়তা বন্ধের বিশেষ অনুরোধ করেছে মিয়ানমার সরকার। একই সঙ্গে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের তরফে তাদের পরবর্তী সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।জিরো লাইনে ৩৪ ও ৩৫ পিলারের মাঝামাঝিতে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের ওপর যৌথ সমীক্ষা চালানোর প্রস্তাবও দিয়েছে মিয়ানমার, যাতে বাংলাদেশ ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী যুদ্ধে পারস্পরিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়ে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বাংলাদেশ অংশের নেতা পররাষ্ট্র সচিবসহ তার সহযোগী সদস্যদের মংডু পরিদর্শনের বিষয়ে দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন। তাদের সীমান্তের সেই এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে জিরো লাইনে মিয়ানমার সাইডে কয়েক হাজার বাস্তুচ্যুত অবস্থান করছে। বিজ্ঞপ্তি মতে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাং পিউ লেট এয়ার এবং না খু ইয়া এলাকার রিসিপশন ক্যাম্প এবং হ্লা পিউ কং এলাকার ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। ওই ক্যাম্পে ৩০ হাজার ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এগুলো বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের গ্রহণে মিয়ানমারের সদিচ্ছার প্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুয়ে জার এলাকায় প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের জন্য ভারতীয় সহায়তায় নির্মিত ১৪৮টি প্রি ফেবরিকেটেড হাউজ পরিদর্শন করেন। তিনি পান তাও পিউই গ্রাম পরিদর্শন করেন। যে গ্রামের ১৫ হাজারের বেশি বাসিন্দা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের মন্ত্রীকে জানানো হয়- সেখানে কিছু মুসলিম, বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী একসঙ্গেই বসবাস করছে। ওই এলাকায় মিয়ানমার সরকার ২২টি বাড়ি নির্মাণ করেছে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের জন্য, আর ৫০টির বেশি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে প্রত্যাবাসিতদের জন্য।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীকে কেইন গি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে এথনিক রাখাইন ও ম্রো জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বসবাস রয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল হেলিকপ্টারে করে দুপুরের আগে সিত্তুয়ে থেকে মংডুর উদ্দেশ্যে রওনা করেন। হেলিকপ্টারের স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমার দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকেই মংডু যেতে পারেননি। তবে মন্ত্রী, সচিব ছাড়াও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের ৫ জন সদস্য মংডুতে যাওয়ার সুযোগ পান। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রস্তুতি সরজমিন দেখানো হয়। সারা দিন সীমান্ত এলাকা এবং মংডুতে ঘুরে তারা বিকালে সিত্তুয়ে ফিরেন। রাতে তারা যান ইয়াংগুনে। আজ বাংলাদেশ দল দেশে ফিরছে। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার নেপিডয় বাংলাদেশ-মিয়ানমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি হটলাইন চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হটলাইনে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আলোচনা হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরাতে যে ফরম তৈরি করা হয়েছে তা পূরণ করতে হবে তাদের নিজেদেরই। বৈঠকের পর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অফিস থেকে বিবৃতিতে এ বিষয়ে জানানো হয়, বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আর মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অফিসের মন্ত্রী চাও তিন সোয়ে। বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়। হটলাইনে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আলোচনা হবে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়- বৈঠকে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে যে ফরম তৈরি করা হয়েছে, তা আলোচনায় উঠে আসে। তবে এ ফরম রোহিঙ্গাদের নিজেদেরই পূরণ করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ৯ই আগস্ট থেকে মিয়ানমার রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আবাসন সুবিধা, চলাফেরা, জীবনযাত্রাসহ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি দেখাই প্রতিনিধিদলের সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য।