সিলেটের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ২০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আজাদুর রহমান আজাদ হলফনামায় একটি বহুল আলোচিত দুর্নীতির মামলার তথ্য গোপন করেছেন। কিচেন মার্কেট খ্যাত ওই মামলার তথ্য আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দীন আহমদ কামরানসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত অর্ধডজনের বেশি কাউন্সিলর প্রার্থী তাদের হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আজাদ করেননি।
শুধু তাই নয়, সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, তথ্য গোপন করার একটি বিতর্কিত অভিযোগ এনে শেষমুহূর্তে ওই ওয়ার্ডের একমাত্র বিএনপি প্রার্থীকে নাটকীয়ভাবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
আজাদুর রহমান আজাদ একাধিক্রমে চারবার নির্বাচিত হওয়ার সময় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হন। এলাকাবাসীর মতে, তিনি ক্ষমতাসীন দলে কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করলেও তিনি বিতর্কের বাইরে নন। সাম্প্রতিক তিন ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মী খুন তারই এলাকায় ঘটেছে এবং প্রতিবারই এসব খুনে তার একটি হাত থাকার অভিযোগ এসেছে।এর আগে এমসি কলেজের হোস্টেলে আগুন দেয়ার ঘটনাতেও তারই ইশারা ছিল বলে মনে করা হয়।
উল্লেখ্য, হলফনামায় মামলার তথ্য গোপনের কারণে সিলেটের রিটার্নিং কর্মকর্তা গত ২রা জুলাই এই ওয়ার্ডে বিএনপি মনোনীত একমাত্র প্রার্থী আবদুল গাফফারের প্রার্থিতা বাতিল করেন। কিন্তু যে মামলার তথ্য তা ভুয়া দাবি করেন গাফফার। কারণ এজাহারে কথিত আবদুল গাফফারের পিতার নাম দেওয়া নেই। সেখানে লেখা অজ্ঞাত। অবশ্য কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রোকেয়া বেগম কমিশনে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তার নামে মামলা (মামলা নং ১৭, তারিখ ১৬/২/২০১৫) আছে। কোতোয়ালি থানায় সরজমিন গেলে তারা ‘ব্যস্ততার’ কারণে রেকর্ড দেখাতে চাননি। কীভাবে রোকেয়া বেগম ওই তথ্য দিলেন জানতে চাইলে কোতোয়োলি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ স্বপ্রণোদিতভাবেও দিতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, আজাদের তথ্য গোপনের অভিযোগ যদি সঠিক হয় তাহলে সিলেটের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে উপনির্বাচনই একমাত্র আইনি পথ।
‘ছোটখাটো ব্যাপার’: অনুসন্ধানে জানা যায়, আবদুল গাফফারের প্রার্থিতা বাতিলের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন আজাদ। তাঁর ওয়ার্ড টিলাগড় সন্ত্রাসের চারণভূমি। সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচনী কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আজাদ আদৌ তথ্য গোপন করেছেন কি না, সেই তথ্য মনোনায়ন যাচাইয়ের শেষ দিনে আমাদের সামনে কেউ আনেনি। তবে এখন তাকে ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করায় বিষয়টি আর আমলে নেয়ার এখতিয়ার তার নেই। এটা নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে গেছে।
মনোনায়নপত্র বাতিল হওয়া প্রার্থী আবদুল গাফফার বর্তমানে চিকিৎসাধীন। তিনি ভারতে চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেছেন, তার মনোনায়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা দেয়ার আগ মুহূর্তে হঠাৎ দুই যুবক সেখানে হাজির হন। তারা তথ্য গোপনের অভিযোগ তোলার একটু পরেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর চার দিন তার জ্ঞান ফেরেনি। হাসপাতালে বদর উদ্দিন কামরান ও আরিফুল হক তাকে দেখতে যান। আপিল করতে হলে তার সই দেয়ার দরকার ছিল। তিনি সই করার অবস্থায় ছিলেন না।
আজাদুর রহমান আজাদসহ অনেকেই সিলেট শহরে এটা রটিয়েছেন যে, অসুস্থ হওয়ার কারণে বিএনপির প্রার্থী ভোট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কিচেন মার্কেট কাহিনী: ১৯৯৬-১৯৯৭ সাল। তখন সিলেট পৌরসভা। নগরীর উপকণ্ঠ শিবগঞ্জে কিচেন মার্কেট ভবন নির্মাণ শেষ করেছে। চেয়ারম্যান ছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ। আজাদ কমিশনার ছিলেন না। ওই মার্কেট তাকে ২০ বছর অন্তর নবায়ন করার শর্তে দীর্ঘমেয়াদে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত দেন কামরান। সিলেটের স্পেশাল জজকোর্টের নথিতে দেখা যায়, সাবেক পৌর নির্বাহী প্রকৌশলী পদ্মা সেন সিনহা এক জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘কেবলমাত্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে’ তিনি আজাদের কাছে কিচেন মার্কেট হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু কামরান তা অগ্রাহ্য করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ২০০১ সালের ২৪শে অক্টোবর আজাদকে ‘সমঝিয়ে’ (বুঝিয়ে) দিয়েছিলেন। এরও চারদিন পর কামরান ২৮শে অক্টোবর কিচেন মার্কেট আজাদকে হস্তান্তরের নোটে অনুমোদন দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালের ২রা জুন স্বাক্ষরিত জবানবন্দিতে তৎকালীন প্রকৌশলী লিখেছেন, ‘পৌরসভার ডিলিং অ্যাসিস্টেন্ট সাইফুল শিবগঞ্জ কিচেন মার্কেটটি সমঝিয়ে দেয়া সংক্রান্ত যার স্মারক নং সা:/৫৮৫/২০০০-০২/২৭৭২ তাং ২৮/১০/০১ প্রস্তুত (২৪/১০/০১)করত: চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করে এবং ২৮/১০/০১ ইং তারিখ চেয়ারম্যান স্বাক্ষর দেন। চেয়ারম্যান কর্তৃক ২৮/১০/০১ চিঠি সই হওয়ার পূর্বে ২৪/১০/০১ মার্কেটটি সমঝিয়ে দেয়া হয়। এই পর্যায়ে এই আমার বক্তব্য।’
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১লা অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তাদের সরকার গঠন পর্বে কিচেন মার্কেটের ইজারা আজাদকে বুঝিয়ে দেন কামরান এবং এর বিরুদ্ধে বিএনপি সরকার কোতোয়ারি থানায় ৮ই মে ২০০৩ কামরান ও আজাদসহ ১৮ জনকে আসামি করে মামলা করে। ২০০৭ সালের এক-এগারোতে এই মামলা সূত্রে আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এক-এগারোতে দাখিল করা অভিযোগপত্রের বরাতে সিলেটের তৎকালীন স্পেশাল জজ মো. ইফতেখার রসুল সিদ্দীক নথিতে লিখেছেন, ‘আপনারা (১৯ জন) পরস্পরের যোগসাজশে ২০০০ সালের ২১শে মে পৌর কমিটির মনগড়া কিছু শর্ত তৈরি করে মন্ত্রণালয়ের পূর্ব অনুমতি না নিয়ে বিনা টেন্ডারে পৌরসভার মালিকানাধীন কিচেন মার্কেটটি প্রতারণা ও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে ক্ষমতার অপব্যবহার পূর্বক লিজ প্রদানের সিদ্ধান্ত এবং পরে লিজের টাকা না তুলে সরকারের ২৩ লাখ ৪০ হাজার ৫৩৭ টাকা ৫৬ পয়সা ক্ষতিসাধন পূর্বক নিজেরা আত্মসাৎ করেছেন। স্পেশাল জজ এরপর লিখেন, আদালতে আসামিরা উপস্থিত (২১ মে, ২০০৭)। তাদের অভিযোগ পাঠ করে শুনানো হলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন।
ব্যতিক্রম কামরান: ২০০৭ সাল থেকে ওই মামলার বিচার আর শুরু হয়নি। অভিযুক্ত কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ আছে উল্লেখ করেছেন। শুধু কামরান লিখেছেন, মিস কেস ১২৮৫২/২০১২ মামলায় হাইকোর্ট থেকে তিনি ১৮ই জুন ২০১২ অব্যাহতি পেয়েছেন।
বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী মোহামদ ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৮ই জুন, ২০১২ প্রদত্ত চার পৃষ্টার রায়ে দেখা যায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য মামলায় বিবাদীর পক্ষের কোনো আইনজীবী অংশ নেননি। আদালতের রায়ে বলা আছে, কেউ রুলের বিরোধিতা করেননি। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী লিখেছেন, এজাহারের বিবরণ এতটাই হাস্যকর যে, যদি ধরেও নিই যে, যা বলেছে তার পুরোটাই সত্যি তাহলেও আবেদনকারীর (কামরানের) বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা চলে না।
উল্লেখ্য, কামরানের মতো একই ধরনের প্রতিকার (কোয়াশ বা সরাসরি খারিজ করা) পেতে আজাদ এবং অন্যান্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা একইভাবে ৫৬১-ক ধারায় হাইকোর্টে মামলা করেছেন। হাইকোর্টে তাদের আইনজীবী মোশতাক আহমেদ বলেন, হাইকোর্ট রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মেয়াদে নিম্ন-আদালতের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত রেখেছেন।
জানতে চাইলে দুদকের একজন আইনজীবী বলেন, দুদককে না শুনে দুদকের মামলা নিষ্পত্তি বা রায় দেয়া যাবে না, এই মর্মে আপিল বিভাগের রায় আছে। দুদক আইনেও তা-ই বলা আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদক চাইলে ২০১২ সালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে এখনও যেতে পারবে। এছাড়া বাকি ১৭ জনের বিষয়ে যে মামলা হাইকোর্টে চলছে তাতে দুদককে পক্ষভুক্ত করতে কমিশনের নজরে আনব।
দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে, দুদককে না শুনে দুদকের মামলায় রায় দেয়ার কোনো সামপ্রতিক নজির নেই।
আজাদই মূল: দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ২০০৩ সালের ওই মামলার সহ-অভিযুক্ত কাউন্সিলরদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, আজাদ লিজের টাকা জমা না দেয়ার কারণেই বিপত্তি বাধে। তারা কমিশনার হিসেবে সভার রেজুলেশনে সই দিয়েছিলেন বলে তারা এতে জড়ান। আর আজাদের যুক্তি হলো- তারা বললে বলতে পারেন, কিন্তু আমি টাকা দিয়েছিলাম অথচ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়নি।
তথ্য গোপনের বিষয়ে আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, ২০০৮ সাল থেকে আমি হলফনামায় এই তথ্য দিয়ে আসছি। আমি কোনো তথ্য গোপন করিনি। নির্বাচনের এত দিন পরে তথ্য গোপনের বিষয়টি কেন সামনে আনা হচ্ছে- এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আজাদ। বলেন, এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তা যাচাই করে নিতে পারেন।
আইন কী বলে: রিটার্নিং অফিসার আলীমুজ্জামান তার নথিতে লিখেছেন, গাফফারের মনোনায়নপত্র নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০ এর ১৪(৩)-এর (ঙ) ধারা বলে বাতিল করা হলো। এই ধারায় আছে, বিধিমতে হলফনামা দাখিল না করা বা দাখিল করা হলফনামায় অসত্য তথ্য প্রদান বা উল্লিখিত তথ্যের সমর্থনে যথাযথ সনদ দাখিল না করা হলে রিটার্নিং অফিসার কারণ দেখিয়ে মনোনায়নপত্র বাতিল করে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যয়ন করবেন।
ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ভোট হয়ে গেলেও রিটার্নিং কর্মকর্তাকেই আজাদকে কারণ দর্শাতে হবে এবং তার ব্যাখার বিবরণ সংবলিত সুপারিশ তাকেই নির্বাচন কমিশনে পাঠাতে হবে। কেউ অভিযোগ না করলেও তিনি দায় এড়াতে পারবেন না। বিশেষ করে এমন একটি মামলার তথ্য যেটি একই নির্বাচনে তার অন্য সবসহ অভিযুক্তরা তাদের হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।