কোটা আন্দোলনের নেতাদের পরিবারে কান্না

কেউ আছেন জেলে। কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নানা অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ঈদ তারা পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন। কিন্তু এবারের ঈদ হয়তো তাদের কাটাতে হবে জেলখানাতে।কারণ ঈদের আগে তাদের জামিন হবে কি হবে না- এ নিয়েও বেশ অনিশ্চয়তা রয়েছে।

এদিকে আদরের সন্তান আর প্রিয়জনকে ছাড়া ঈদ করতে হবে- এমনটা ভাবতে পারছেন না তাদের পরিবারের সদস্যরা। কোটা আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানের ছোট বোন সোনিয়া বলেন, মা ও ভাবি গতকাল খুব সকালে উঠে ভাইয়ার সঙ্গে কেরানীগঞ্জ জেলখানায় দেখা করতে গেছেন। একটু বেলা হয়ে গেলে জেলখানার অন্য আসামিদের সঙ্গে মারামারি ও ধাক্কাধাক্কি করে ভাইয়ার কথা বলতে হয়।

বাবা-মা দুজনই ভাইয়ার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মা অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন ভাইয়াকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য। বাবার কিডনির ব্যথাটা বেড়েছে। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। কিন্তু বাবার এক কথা রাশেদ জেল থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি অপারেশন করাবেন না। ভাইয়া প্রতিবছর ঈদের এক সপ্তাহ আগে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন। অথচ এবছর ভাইয়াকে ছাড়া আমাদের প্রথম ঈদ করতে হবে।

এটা ভেবেই মা কান্না করে আর বলে আমার বাবুকে ছাড়া আমি কেমনে ঈদ করবো। এরকম ঈদ যেন আর কখনো না আসে। গত সপ্তাহে ভাইয়া মা’কে বললো মা তুমি ঈদে বাসায় যাবে না। তখন মা বললো মনি তোমাকে ছাড়া আমি বাড়ি যাবো না। আগামী বছর তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে ঈদ করবো। সোনিয়া বলেন, ভাইয়াকে ছাড়া ঈদ কি কখনো ভালো হয়। প্রতিবছর ঈদের আগে ভাইয়া বাড়ি যাওয়ার সময় বলতো তোমাদের কি লাগবে, কি নিয়ে আসবো। ভাইয়া ঈদের সময় বাসায় গেলে আমাদের কাছে উৎসব মনে হতো। এখন মনে হয় সবকিছু অন্ধকার।

ভাইয়াকে ছাড়া চারদিক কেবলই ফাঁকা আর শূন্য মনে হয়। এরকম ঈদ আমরা চাই না। ভাইয়ার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে ভালো একটা চাকরি করবে। তখন আর আমাদের কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। গত সপ্তাহে ভাইয়া মাকে বলেছিল, মা ঈদের আগে তুমি আরেকবার দেখা করতে আসবে। অনেক দিন তোমার হাতে বাসার রান্না করা খাবার খাই না। প্রতিবছর ঈদে বাসায় গেলে যেভাবে রান্না করে খাওয়াতে ঈদের দিন খুব সকালে ঠিক তেমন খাবার রান্না করে নিয়ে আসবে। কোরবানির ঈদে ভাইয়া গরুর মাংস আর খিচুড়ি বেশি পছন্দ করতো। তাছাড়া ঈদের দিন সকালে মায়ের রান্না করা সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যেতেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও কোটা আন্দোলনের নেতা পি এম সুহেলের ছোট ভাই সুমন রহমান বলেন, এটা ভাবতেই কষ্ট হয় ভাইয়াকে ছাড়া এবছর আমাদের ঈদ করতে হবে। আমাদের জীবনে এমন একটি ঈদ আসবে ভাবতেও পারিনি। প্রতিবার ঈদের ৩ থেকে ৪ দিন আগে ভাইয়া বাসায় চলে আসতেন। বাসায় চাচাতো ভাইদের ছেলেমেয়ে, চাচা-চাচী, মা সবার জন্য জামা-কাপড় নিয়ে যেতেন। গরিব লোকদের টাকা ও কাপড় কিনে দিতেন।

ঈদে গরুর মাংস দিয়ে চালের রুটি খেতে ভাইয়া বেশি পছন্দ করতো। গতকাল সকালে ভাইয়াকে দেখে এসেছি। ভাইয়া বললো আমার জন্য চিন্তা করিস না। ঈদের দিন আমরা যারা জেলখানায় আছি তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবি। ভাইয়া বলেছে, তাদের ১০ জনের জন্য মায়ের হাতের খাবার রান্না করে নিয়ে যেতে।

কোটা আন্দোলনের নেতা মশিউরের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, এ বছর আমাদের ঈদ হবে না। আমাদের ঈদটা মাটি হয়ে গেছে। তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে একত্রে ঈদ করবো সেটা আমার কপালে নেই। ঈদ নিয়ে আমাদের আনন্দ বলতে কিছু নেই। আছে একবুক কষ্ট আর চোখভর্তি জল। গত শনিবার মশিউরের সঙ্গে দেখা করে এসেছি। ঈদের দিন আমার ছেলেকে জেলখানায় খাবার দেবে এমন কেউ নেই। বরিশালের ঝালাকাঠিতে তাদের বাড়ি।

মশিউরের বাবা পেশায় একজন রিকশাচালক। তিন ভাইবোনের মধ্যে মশিউর মেজ। বড় ভাই ঢাকাতে প্রাইভেট গাড়ি চালায়। মশিউরের বাবা বলেন, মশিউর ঈদে তার মায়ের হাতে রান্না করা গরুর মাংসটা বেশি পছন্দ করতো। আমরা তো গরিব মানুষ তাই কোরবানি দিতে পারি না। দশজনে যেটুকু মাংস দিতো তাই দিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঈদ করতাম। এবছর কোরবানি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছেলেকে জেলে রেখে কোরবানি দেই কীভাবে।

উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মামলায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের দশ জন নেতা গ্রেপ্তার হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *