রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক আবারো আর্থিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে। তবে তার আগেই বন্ড ছেড়ে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটি। এই উদ্যোগে কোনো বেসরকারি ব্যাংক আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য এর আগে বিপর্যস্ত ব্যাংকটিকে বাঁচাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে ব্যাংকটির ৫০০ কোটি টাকার বন্ড কিনতে প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং আইসিবি। এদিকে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে এক হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমোদনও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দুই দফায় ৫০০ কোটি টাকা করে বাজার থেকে এই অর্থ সংগ্রহ করবে ব্যাংকটি। ইতিমধ্যে চার ব্যাংক ও আইসিবির কাছে বন্ড বিক্রির প্রস্তাব পাঠিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক।এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংককে প্রস্তাব দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা, অগ্রণী ও রূপালী প্রতিটি ব্যাংকের কাছে ১০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রির প্রস্তাব পাঠিয়েছে ব্যাংকটি। এরই মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ফারমার্স ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম বলেন, ফারমার্স ব্যাংক উদ্ধার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা ১৬৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছি। আরো ১০০ কোটি টাকার বন্ড কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছি। আশা করছি, ফারমার্স ব্যাংককে লাভজনক করতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসে ফারমার্স ব্যাংকে ৭১৫ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠান। নতুন করে জোগান দেয়া মূলধন যুক্ত হয়ে ফারমার্স ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ১১৬ কোটি টাকা।
এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা করে মূলধন জোগান দেয়। আইসিবিকে দিতে হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। যদিও প্রতিষ্ঠালগ্নেই আইসিবি ৬০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছিল। এর বাইরে ফারমার্স ব্যাংককে ধার দেয়া রাষ্ট্রায়ত্ত এ চার ব্যাংকের প্রায় ৫৫০ কোটি টাকাও আটকে আছে। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ১৫০ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে।
২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকের যাত্রা হয় ৪০১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে। এর মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি-উদ্যোক্তার বিনিয়োগের পরিমাণ ২৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৭৩.১১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ১০০ কোটি টাকা, যা মোট মূলধনের ২৮.৯০ শতাংশ। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল ফারমার্স ব্যাংকে। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ফারমার্স ব্যাংকের আমানত ছিল ৪ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা। আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে ফারমার্স ব্যাংক। এর মধ্যে ৯৬৭ কোটি টাকার ঋণ নাম লিখিয়েছে খেলাপির খাতায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ। বিপর্যস্ত ব্যাংকটি ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ফারমার্স ব্যাংকে আমানত জমা রেখে ফেরত পায়নি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা না পেয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দফায় দফায় অভিযোগ জানিয়েছে। আমানত তুলতে মুখিয়ে আছে বেসরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানসহ ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রাখা গ্রাহকরাও।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে গত বছরের শেষের দিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৭শে নভেম্বর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। একই দিন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীও পদচ্যুত হন। এরপর ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদকে চেয়ারম্যান ও মারুফ আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন করে ব্যাংকটির সব ক’টি কমিটি পুনর্গঠন করে ঢেলে সাজানো হয়।
ব্যাংকটির পুনর্গঠিত পর্ষদের পরিচালকদের অন্তত ২০০ কোটি টাকার জোগান দিতে গভর্নর ফজলে কবির নির্দেশ দেন। নতুন পর্ষদকে তিন মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু পরিচালকরা টাকা না দেয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এরপর মোহাম্মদ মাসুদকে সরিয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে চৌধুরী নাফিজ সারাফাত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে ক্ষত সৃষ্টি করা ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তোলার দায়িত্ব এককভাবে কাঁধে তুলে নেয় সরকার।
ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা পাওয়া গেলেও এখনো সমস্যা কাটেনি। তবে আগের চেয়ে চাপ কমেছে। তিনি বলেন, বন্ড বিক্রি করে এক হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার যে পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে, সেটা বাস্তবায়িত হলে চাপ আরো কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ম বন্ধ করে বিতরণ করা ঋণগুলো আদায় করা গেলে বেশি উপকার হতো। এছাড়া ব্যাংকটিকে ছোট করে আনার মধ্যদিয়েও সমস্যার সমাধান হতে পারে