আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা অবসর নিয়ে যা বললেন

আগামী বছর চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন চীনের টেক জায়ান্ট আলিবাবা’র চেয়ারম্যান জ্যাক মা। তখন আলিবাবার দায়িত্ব তিনি সিইও ড্যানিয়েল ঝ্যাঁ’কে বুঝিয়ে দেবেন। তবে ২০২০ সাল পর্যন্ত আলিবাবার বোর্ডে থাকবেন জ্যাক মা। আলিবাবা থেকে নিজের সরে যাওয়া নিয়ে গ্রাহক ও শেয়ার হোল্ডারদের কাছে একটি চিঠিও পাঠান তিনি। নিচে সেই চিঠি তুলে ধরা হলো-

প্রিয় আলিবাবা গ্রাহক, আলি ও শেয়ার হোল্ডার,

আজ (১০ সেপ্টেম্বর) আলিবাবার ১৯তম বার্ষিকীতে, আমি আপনাদের সঙ্গে কিছু তথ্য শেয়ার করতে আগ্রহী। বোর্ড অব ডিরেক্টরদের সম্মতিতে আগামী বছর ১০ সেপ্টেম্বর আলিবাবার ২০তম বার্ষিকীতে গ্রুপের সিইও ড্যানিয়েল ঝ্যাঁ আলিবাবা গ্রুপের বোর্ড অব চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। আগামী ১২ মাস নির্বাহী চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় একটি মসৃণ ও সফল হস্তান্তরের পর ড্যানিয়েলের সঙ্গে আমি গভীরভাবে কাজ করবো। তাই আগামী ২০২০ সালে আমাদের শেয়ার হোল্ডারদের বার্ষিক মিটিংয়ের আগ পর্যন্ত আমি আলিবাবা বোর্ড অব ডিরেক্টরে থাকবো।

আমার উত্তরসূরী কে হবে দশ বছর ধরে আমি সেটি নিয়ে ভেবেছি এবং প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি আনন্দের সঙ্গে আজ সেই ঘোষণা দিতে পারার জন্য আলিবাবা পার্টনারশিপ এবং আমাদের বোর্ড অব ডিরেক্টরদের ধন্যবাদ জানাই। আমি আলিবাবার সব সহকর্মী এবং তাদের পরিবারকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই, কারণ গত ১৯ বছর আপনাদের বিশ্বাস, সমর্থন এবং আমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় আস্থা এবং শক্তির মাধ্যমে এই দিনটির জন্য প্রস্তুত হতে পেরেছি। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই বিষয়টির মাধ্যমে বোঝা যায়, আলিবাবা কোম্পানি থেকে করপোরেট গভর্নেন্সে উন্নীত হয়েছে, যেখানে ব্যক্তি নয় বরং সাংগঠনিক দক্ষতা ও মেধা উন্নয়নের সংস্কৃতিরই প্রাধান্য।

১৯৯৯ সালে যখন আলিবাবা প্রতিষ্ঠা পায়, তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যা চীন তথা বিশ্বকে গর্বিত করবে এবং যেটি তিন শতক অতিবাহিত করে ১০২ বছর টিকে থাকবে। যদিও আমরা সবাই জানতাম যে, কেউই এই কোম্পানিতে ১০২ বছরের জন্য থাকতে পারব না। সুশাসন, সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক দর্শন এবং ধারাবাহিক মেধার উন্নয়নের মাধ্যমেই একটি টেকসই আলিবাবা গড়ে তুলতে হবে। কোনও কোম্পানিই কেবল এর প্রতিষ্ঠাতাদের ওপর নির্ভর করতে পারে না। সব মানুষের মধ্যে এটি জানা থাকা উচিত। কারণ দক্ষতা ও শক্তির যে শারীরিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এর ফলে কেউই সারাজীবন চেয়ারম্যান এবং সিইও’র দায়িত্ব পালন করতে পারে না।

১০ বছর আগেই আমরা নিজেদের এই প্রশ্ন করেছি-জ্যাক মা কোম্পানি ছেড়ে গেলে কীভাবে আলিবাবা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে? করপোরেট নেতৃত্ব হস্তান্তরের এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ধারাবাহিকভাবে মেধার উন্নয়ন এবং উত্তরসূরী তৈরির জন্য একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ও মেকানিজমের ভিত্তিতে সুশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। গেলো ১০ বছর ধরে আমরা এগুলো নিয়েই কাজ করেছি।

শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষিত হওয়ায়, আমার যা অর্জন তা নিয়ে আমি খুবই গর্বিত। শিক্ষকরা সবসময় চান যে তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদেরকে ছাড়িয়ে যাক। তাই আমিও মনে করি কোম্পানির জন্য দায়িত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তরুণ, মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া; যাতে তারা আমাদের ‘যেকোনও জায়গায় ব্যবসা করার’ মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসা, তরুণ ব্যক্তি এবং বিশ্বজুড়ে নারীদের সাহায্যে এই মিশন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার প্যাশন। ব্যবসার প্রথমদিন থেকে এটি কেবল আমাদের ইচ্ছাই ছিল না বরং এ ধরনের সুযোগ পেয়ে আমি সৌভাগ্যবান। এই মিশনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুধু জ্যাক মা নয় বরং আরও অনেক মানুষ এবং আলিরেনের প্রজন্মের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

আলিবাবা খুব বিস্ময়কর, তবে এটি আমাদের ব্যবসা বা পরিধি বা অর্জনের জন্য নয়। আলিবাবার ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে একটি কমন মিশন এবং ভিশন নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের পার্টনারশিপ ব্যবস্থা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মেধাসম্পন্ন টিম আমাদের কোম্পানির লিগ্যাসির জন্য শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। বস্তুত ২০১৩ সালে যখন সিইও’র দায়িত্ব ছেড়ে দিই, তখন এই প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানগুলোর ওপর ভর করেই কোম্পানি মসৃণ চলেছে।

সুশাসন ও টেকসইয়ের জন্য আমরা এই পার্টনারশিপ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে, যা অবিরাম উদ্ভাবন, নেতৃত্ব, জবাবদিহিতা এবং সাংস্কৃতিক চলমানতা কোম্পানির বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজে দিয়েছে। আমাদের ব্যবস্থাপনা মডেলকে একটি জায়গায় দাঁড় করাতে আমরা সিস্টেম এবং ব্যক্তির মধ্যে সঠিক ভারসাম্যের উন্নয়ন ঘটাতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। শুধু কোনও ব্যক্তি বা অন্ধের মতো একটি সিস্টেম অনুসরণ করলে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সিস্টেম, মানুষ ও সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য প্রয়োজন। আমার পুরোপুরি বিশ্বাস যে আমাদের পার্টনারশিপ সিস্টেম এবং আমাদের সংস্কৃতি সুরক্ষার চেষ্টা গ্রাহক, কর্মী ও শেয়ার হোল্ডারদের ভালোবাসা ও সমর্থন আদায় করে নেবে।

১৯৯৯ সালে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভের পরই বুঝতে পেরেছি আমাদের ব্যবস্থাপনা উত্তরসূরী পরিকল্পনায় বাস্তবায়নের জন্য আলিবাবার ভবিষ্যৎ ‘মেধার পালের’ ওপর নির্ভর করতে হবে। বহু বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর, আজ আলিবাবায় মান ও পরিমাণে বিশ্বমানের একদল মেধাবি লোক রয়েছে। আমার ভেতরকার শিক্ষক আমাদের টিম, নেতৃত্ব এবং আমাদের নিজস্ব মিশননির্ভর সংস্কৃতি ড্যানিয়েল ঝ্যাঁ’র মতো ব্যতিক্রমী ব্যবসায়ী নেতা এবং প্রফেসনাল মেধার নিয়মিত উন্নয়ন ঘটাতে পেরে আমার ভেতরকার শিক্ষক আমাদের টিম, নেতৃত্ব এবং আমাদের নিজস্ব মিশননির্ভর সংস্কৃতি নিয়ে খুবই গর্বিত।

আলিবাবা গ্রুপের সঙ্গে ১১ বছর ধরে আছে ড্যানিয়েল। সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সে তার দারুণ মেধা, ব্যবসায়িক অন্তর্দৃষ্টি এবং নেতৃত্বের দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। তার অধীনে টানা ১৩ কোয়ার্টারে আলিবাবার ধারাবাহিক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তার বিশ্লেষণাত্মক মন অদ্বিতীয়, সে আমাদের মিশন ও ভিশনকে আগলে রাখে, প্যাশনের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন, ব্যবসায় মডেলের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন ও ক্রিয়েটিভ পরীক্ষা চালানোর দুঃসাহস রয়েছে তার। চীনের ব্যবসাভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম তাকে ২০১৮ সালে এক নাম্বার সিইও হিসেবে উল্লেখ করে। এই কারণে সে এবং তার টিম গ্রাহক, কর্মী ও শেয়ার হোল্ডারদের আস্থা ও সমর্থন জিতে নিয়েছে। ড্যানিয়েল ও তার টিমের কাছে সঠিক সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর যথাযথ সিদ্ধান্ত, কারণ তাদের সঙ্গে কাজ করে আমি জেনেছি যে তারা প্রস্তুত এবং আমাদের পরবর্তী নেতৃত্বের ওপর আমাদের পুরোপুরি আস্তা রয়েছে।

আর আমার কথা বলতে গেলে, এখনও অনেক স্বপ্ন ছোঁয়া বাকি আছে। যারা আমাকে চেনন, তারা জানেন আমি অলস বসে থাকতে পছন্দ করি না। আলিবাবা পার্টনারশিপে প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যেতে যাই এবং পার্টনারশিপে অবদান রাখতে চাই। আমি আবারও শিক্ষকতায় ফিরে যেতে চাই, কারণ শিক্ষকতা করতে আমি খুব পছন্দ করি। বিশ্বটা অনেক বড় এবং আমি এখনও তরুণ, তাই আমি নতুন কিছু করতে চাই- কেননা যদি নতুন স্বপ্ন পূরণ হয়?

একটি বিষয় আমি সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি: আলিবাবা কখনও জ্যাক মা’কে নিয়েই নয়, কিন্তু জ্যাক মা সবসময়ই আলিবাবার থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *