সালমা খাতুন, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। নারী ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণার নাম। তার দলের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম কোন টুর্নামেন্টের শিরোপা। কিন্তু অনেকেরই অজানা, এশিয়া কাপে এই ট্রফি জয়ের ‘উল্লাস’ তাদের কত ঘাম-শ্রম, ত্যাগ আর চোখের জলে ছিনিয়ে আনা! জীবন, সংসার আর পরিবেশের সঙ্গে তাদের কতটা যুদ্ধ করতে হয় প্রতিনিয়ত বলতেই সালমার চোখের কোণে অশ্রু চলে আসে। কষ্টে মুখ লাল হয়ে ওঠে। দৈনিক ইশতিয়াক পারভেজের সঙ্গে তার সেই সব সংগ্রামের গল্প তুলে ধরেছেন সালমা খাতুন। কক্সবাজারে সাগর পাড়ে বলা সেই কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: ক্রিকেট শুরুর আগে ও এখন- নিজের মধ্যে কি পরিবর্তন দেখছেন?
সালমা: অনেক বড় পার্থক্য। যদি ক্রিকেট না খেলতাম হয় আজ সংসার হতো।বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিতেন। কিন্তু ক্রিকেটার হওয়ার পর সেই সব কিছু থেকে অনেক দূরে। এমনকি পরিবার থেকেও। এখন যেটা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে মনে হয় দেশের জন্য কিছু করতে হবে। আমার দলটিকেই আমি পরিবার মনে করি। তাদের সঙ্গেই আমার সুখ দুঃখ ভাগ করি।
প্রশ্ন: ক্রিকেট খেলায় আসলেন কিভাবে?
সালমা: আমার যখন ৭ বা ৮ বছর তখন থেকেই মামাদের সঙ্গে খেলতাম। তখন মনে হতো যদি জার্সি পরে খেলতাম। এরপর একদিন আমাদের সুযোগ এলো খুলনার কোচ সালাউদ্দিন (প্রয়াত মোহাম্মদ সালাউদ্দিন) স্যার ও পিলু (ইমতিয়াজ হোসেন পিলু) স্যারের হাত ধরে। এরপর ১২ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছি।
প্রশ্ন: সেই সময় ট্রাউজার ও জার্সি পরে খেলা কতটা কঠিন ছিল?
সালমা: আমি তো বাসায় সালোয়ার কামিজ পরে খেলতাম। আমার মনে আছে যখন সালাউদ্দিন স্যারের কাছে যাই সেদিনও তাই পরা ছিল। আমার কাছে জার্সি কেনার মতো টাকা ছিল না। স্যার আমাকে তখন ট্রাউজার-জার্সি, জুতা কিনে দেন। তা দিয়ে প্রায় কয়েক বছর খেলেছি। শুরুতে মানুষ যেন কিভাবে তাকাতো। আমি নদী পার হয়ে মাঠে আসতাম। লোকজন তাকিয়ে থাকতো। কেউ কেউ পিছন থেকে নানা কথা বলতো। আমি লজ্জা পেতাম। যে কারণে বাসা থেকে জার্সির উপরে অন্য একটা কিছু পরে আসতাম। অবশ্য আর এই সবের পাত্তা দেইনি। এখনো যে পিছন থেকে কথা শুনিনা তা নয়।
প্রশ্ন: সেই পরিস্থিতিতে পরিবারের কতটা সমর্থন পেয়েছেন?
সালমা: আমরা চার ভাই-বোন আমি সবার ছোট। মা আমাকে সব রকম সমর্থন দিয়েছেন। তার কাছ থেকেই আমি সাহস পেয়েছি। মেয়ে মানুষ বিয়ে কেন দেয় না এমন অনেক কথা হয়তো মাকে শুনতে হয়েছে। আর এখনতো মানুষ প্রশংসা করে।
প্রশ্ন: ক্রিকেট খেলে টাকা পাবেন তা ভেবেছিলেন?
সালমা: আমরা যখন ক্রিকেট শুরু করি তখন টাকার কথা ভাবাই যেত না। যা টুকটাক পেতাম তা থেকেই বাঁচাতাম। আর বছরে একবার যে ব্যাট-বল বা জার্সি পেতাম সেগুলোকেই অনেক যত্ন করে ব্যবহার করতে হতো। এক জোড়া জুতা দিয়ে আমরা দুই তিন বছর চালিয়েছি। পরে অবশ্য একটু একটু করে টাকা বেড়েছে কিন্তু তেমন না। সেখান থেকেই নিজের জন্য একটু করে রাখতাম, সংসারে দিতাম।
প্রশ্ন: ক্রিকেট থেকে প্রথম বড় অঙ্কের টাকা কবে পেয়েছিলেন?
সালমা: ২০০৭ এ জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়াতে গিয়েছিলাম। সেবার বিদেশে দৈনিক খাওয়ার জন্য যে টাকা পেয়েছি আমরা মেয়েরা সেখান থেকে বাঁচাতাম। কেউ ৩০ কেউ ২০ হাজার বাঁচিয়ে দেশে নিয়ে এসেছিল। আমি ২৫ হাজার টাকা জমিয়ে ছিলাম। তাতেই কি যে খুশি! এত টাকা আমার কাছে!
প্রশ্ন: কি করলেন ২৫ হাজার টাকা?
সালমা: আমার কাছে ২৫ হাজার টাকা মানে তখন অনেক বড় কিছু। কারণ আমার পরিবার খুলনায় যে বাসায় থাকি সেটি ছিল গোলপাতায় করা। মানে বাঁশের বেড়ার উপর গোলপাতা দিয়ে ছাউনি দেয়া। খুব কষ্ট হতো আমার মায়ের চার সন্তান নিয়ে এমন ঘরে থাকা। তাই আমি ঠিক করে ফেলি বাসায় ফিরেই গোলপাতার পরিবর্তে টিনের ছাউনি দিবো। তবে যেহেতু মামা বাড়িতে থাকি তারা রাজি হলেন না। মন খারাপ হয়ে যায় কি করবো কি করবো ভাবছিলাম। আমার নানি আমার মাকে যে ছোট্ট একটু জায়গা দিয়েছিল সেখানে ঘর করার সিদ্ধান্ত হলো। হঠাৎ মা বললেন কোনো ভাবে যদি বাঁশের বেড়ার পরিবর্তে পাকা করে তোলা যায় তাহলে ভালো হয়। কিন্তু ২৫ হাজার টাকায় কি তা হয়! কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি আমার কোচ পিলু স্যারের কাছ থেকে আরো কিছু টাকা ধার নিয়ে পাকা বাড়ি তুলতে শুরু করলাম পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল দিয়ে। আমার মনে হলো সেটিই আমার স্বপ্নের পাকা বাড়ি। কি যে ভালো লেগেছে মায়ের মুখে হাসি দেখে। আমার মাও ভীষণ খুশী যে তার ছেলেরা যা করতে পারেনি আমি মেয়ে হয়ে তা করেছি। এরপর আস্তে আস্তে ক্লাবে খেলতে শুরু করলাম। টাকাও বেশ ভালো পাচ্ছিলাম। শুরুতে যেখানে পাকা তিনটি ঘরছিল সেটিকে পাঁচটি করেছি।
প্রশ্ন: এ দেশে নারী ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কতটা দেখেন?
সালমা: এশিয়া কাপ জয়ের আগ পর্যন্ত ‘অনেক ভালো’ বলার সাহস পেতাম না। এখনতো মেয়েদের অধিকার অনেক। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও দারুণ সমর্থন দেন। সব মিলিয়ে বলবো যদি ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারি তাহলে এই নারী দল ছেলেদের মতই দেশকে অনেক কিছুই দেবে।
প্রশ্ন: এখনো প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন?
সালমা: প্রতিবন্ধকতা একেবারে নেই তা বললে ভুল হবে। তবে আগে বাবা-মায়েরা মেয়েদের যে কোনো ধরনের খেলাতেই মেয়েকে দিয়ে সাহস পেতো না। এখন কিন্তু অনেক বাবা-মাই মেয়েদের খেলতে নিয়ে আসেন। তারা চান তাদের মেয়েটি বড় ক্রিকেটার হোক। এখন আমাদের দায়িত্ব হলো তা ধরে রাখা। এতে করে পাইপ লাইনে অনেক ক্রিকেটার আসবে। কারণ আমরা তো আর চিরদিন খেলবো না। তখন কাউকে তো হাল ধরতে হবে।
প্রশ্ন: ক্রিকেট ছাড়লে কি করবেন?
সালমা: যদি আল্লাহ কপালে লিখে রাখে আর কেউ আমাকে বিয়ে করতে চায় হয়তো সংসার করবো। কিন্তু যাই করি মাঠ আমি ছাড়তে পারবো না। কারণ আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেট এখন আমার জন্য খেলা নয়, দায়িত্ব। যদি আমি দুই, তিনজন মেয়ে ক্রিকেটারও তৈরি করে দিতে পারি দেশের জন্য, মনে করবো কিছুটা হলে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। দেশ আমাকে যা দিয়েছে সেই ঋণ তো শোধ করতে পারবো না।
প্রশ্ন: জীবনে বড় কোনো আফসোস?
সালমা: আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আর তা শেষ করতে পারিনি। এখন মনে হয় যদি পড়ালেখাটা শেষ করতে পারতাম তাহলে হয়তো আরো ভালোভাবে ক্রিকেট খেলতে পারতাম। অধিনায়ক হিসেবে সব দিক থেকে যোগ্য থাকতাম।