নিচতলা থেকে ছয় তলা। সিঁড়ি দিয়ে বারবার উঠছিলেন, নামছিলেন। কখনো দু’তলা, কখনো তিন তলা। চোখে-মুখে ক্লান্তি। মাথা থেকে ঘাম ঝরছে। কথা বলতে গেলে বিমর্ষ মুখে তাকালেন। নিজের নামটি সংশোধন করার জন্য দুই দিন ধরে ঘুরছেন পাসপোর্ট অফিসে। সমাধান হচ্ছে না।ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা এই যুবকের নাম আরিফ। শুধু আরিফই না, প্রতিদিন শত শত ‘আরিফ’ পাসপোর্ট সংক্রান্ত নানা কাজে এখানে আসেন। সারিবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়ান। ফরম জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। প্রথম প্রথম গিয়ে অনেকে ঝামেলায় পড়েন। আর এই সুযোগটিই নেয় দালাল চক্র। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে যে কাজটি করাতে পারেননি সেই কাজটি গ্যারান্টি দিয়ে করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় দালালরা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এরকম দৃশ্য প্রতিদিনের। কার্যালয়টিকে দালালমুক্ত করতে কর্তৃপক্ষ সময়ে সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
এখনও উদ্যোগ আছে। পরিচালিত হচ্ছে অভিযানও। দৃশ্যপট আগের চাইতে কিছুটা পাল্টেছেও। কিন্তু হয়রানি পুরো বন্ধ হয়নি। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে ভেতরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে দালাল চক্র। মঙ্গলবার দিনভর পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই সারিবদ্ধ মানুষ। মানুষের দীর্ঘ সারি অফিসের প্রধান ফটক পর্যন্ত। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। বাইরের সড়কেও মানুষের ভিড়। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে-বসে আছেন তারা। দুই পাশে পার্কিং করা শতাধিক মোটরসাইকেল। এর মধ্যেই দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ সদস্যরা। আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছে দালালরা।
কাউকে দেখলেই জানতে চাইছে, কি কাজ করাতে এসেছেন। পরিচয় গোপন করে কথা হয় আকবর, রহিম, মারুফসহ বেশ কয়েকজন দালালের সঙ্গে। মারুফ জানান, তিনি করতে পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। শুধু টাকা বাড়িয়ে দিলেই হবে। তার এই ক্ষমতার উৎসও টাকা। টাকার ভাগ নাকি দিতে হয় আরো অনেককেই। যে কারণে তাদের কাজ আটকায় না কোথাও। মারুফ বলেন, যে কাজ করতে দিনের পর দিন আপনাকে ঘুরতে হবে সে কাজ আমরা অল্প দিনে করে দেব।
পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে সিঁড়ির সামনে কথা হয় আরিফের সঙ্গে। দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী এই যুবক ভীষণ ক্লান্ত, বিষণ্ন। তিনি জানান, পাসপোর্টে তার যে নাম জাতীয় পরিচয়পত্রে একটু ভিন্ন। নামটি সংশোধন করতে সোমবার যান আগারগাঁওয়ের এই পাসপোর্ট অফিসে। নিচতলার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় ঘণ্টা পরে ১০৩ নম্বর কাউন্টারে কথা বলে হতাশ হন তিনি। বর্তমান ঠিকানা মিরপুর শোনার পরই তাকে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস উত্তরায় যেতে বলা হয়। ছুটে যান উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে প্রথমে দ্বিতীয় তলায় কথা বলেন এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি তাকে চতুর্থ তলায় যেতে বলেন। সেখানে কথা হয় এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, উত্তরা অফিসেও এই পাসপোর্ট সংশোধন করা যাবে না। কারণ হিসেবে জানান, পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়, স্থায়ী ঠিকানা লক্ষ্মীপুর। তাই এটি উত্তরার অফিসে হবে না। এমনকি এটি দেশে না-ও হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দু’চোখে অন্ধকার দেখেন আরিফ। আবার ফিরেন আগারগাঁও। এবার ভিন্নপথে হাঁটেন তিনি। এগিয়ে আসে দালাল আবদুল মান্নান। তার কাছে অসম্ভব বলে কিছু না। দাবি করে ২৫০০ টাকা। আলোচনা করে ২০০০ টাকায় রাজি। এবার কোনো লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। তাকে সঙ্গে নিয়ে ১০৩ নম্বর কাউন্টারে ফরম জমা দেন মান্নান। অথচ তখনও দীর্ঘ লাইনে শতাধিক মানুষ। ফরমে আবেদিত লেখা সিল দিয়ে আরিফকে পাঠানো হয় তৃতীয় তলায় ৩০৫ নম্বর কাউন্টারে। তাড়াহুড়া করেই তাকে রিসিভ কপি ধরিয়ে দেয়া হয়। হাতে নিয়ে অবাক তিনি। কোনো সংশোধন নেই। নাম যা ছিল তাই আছে। এমনকি জরুরি ফি ৬৯০০ টাকা ব্যাংকে জমা দিলেও রিসিভ কপিতে লিখে দেয়া হয় রেগুলার। যার ফি ৩৪৫০ টাকা। এসব বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয় কাউন্টারে থাকা রাজীব নামক ব্যক্তির সঙ্গে।
রাজীব বলেন, কিচ্ছু করার নেই, এন্টি হয়ে গেছে। রাজীবের পরামর্শে যান ছয় তলার ৬০৫ নম্বর কাউন্টারে। সেখান থেকেও জানানো হয়ে কম্পিউটারে এন্টি হয়ে গেছে কিচ্ছু করার নেই। নতুন করে সব করতে হবে। আবার নিচে নেমে ৩০৫ নম্বর কাউন্টারে যান। পরামর্শ একটাই নতুন করে করতে হবে। আরিফ জানান, ভুলটা আমার না। তবু আমাকে কেন নতুন করে টাকা দিতে হবে- এই প্রশ্ন করায় তারা আরো রেগে যান। চেষ্টা করেন পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি তাকে অবগত করতে। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীদের বাধায় সম্ভব হয়নি। আবার দালাল মান্নানের কাছে যান। এবার মান্নানের অনুরোধে এক নারী দালাল এগিয়ে আসেন। তিনি এই পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী বলে পরিচয় দেন। আরিফকে নিয়ে তিনি যান একজন কর্মকর্তার দপ্তরে। তিনি রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর দিলে ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলে আরিফের।
একইভাবে ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান জানান, গত নভেম্বরে পাসপোর্ট করেছেন তিনি। তার মায়ের নামে ভুল। রিসিভ কপি হাতে নিয়ে তাৎক্ষণিক তা বুঝতে পারেননি। পরদিন পাসপোর্ট অফিসে গেলে তার ফাইলই খুঁজে পাননি কর্তৃপক্ষ। এভাবে সিঁড়ি দিয়ে তিন তলা, চার তলা আর ছয় তলায় উঠতে-নামতে ক্লান্ত মিজানুর ছুটে যান পরিচালকের রুমে। তার রেফারেন্স গেলে সঙ্গে সঙ্গেই ফাইল খুঁজে পান। কিন্তু সার্ভারে সমস্যা জানিয়ে বলা হয়, সংশোধনটি এখন হচ্ছে না। পুলিশ ভেরিফিকেশনের পরে আসেন। তারপর আরো কয়েকবার গেলেও সংশোধন আর হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলেন, আগে আসেননি কেন, এখন আর হবে না।
পাসপোর্টে বয়স বেশি, এক বছর কমাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র পরামর্শ চাচ্ছিলেন প্রধান ফটকের সামনে কর্তব্যরত রাকিব নামে পুলিশ সদস্যের কাছে। সব শুনে অদূরে দাঁড়ানো বয়স্ক এক দালালের কাছে যেতে পরামর্শ দেন রাকিব। ইশারা দেন দালালকে। আকবর নামে ওই দালাল ছাত্রের কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করে। এর মধ্যেই ঘটে আরেক ঘটনা। দালাল মান্নানের কাছে টাকা খুঁজেন পুলিশের এক সদস্য। টাকা না পেয়ে তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান।
পাসপোর্ট অফিসের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো কেরানীগঞ্জের যুবক ইমরান আহমেদ জানান, পাসপোর্ট করানোর জন্য দালালকে টাকা দিয়েছিলেন। এখন আর তার হদিসই পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত নিজেই পাসপোর্ট করেছেন। মঙ্গলবার সেখানে গিয়েছিলেন ভাতিজার পাসপোর্ট করানোর জন্য।
সরজমিন পাওয়া অভিযোগগুলোর বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অধিদপ্তরের পরিচালক (বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এখানে আমরা কোনো অনিয়ম দেখতে চাই না। সেজন্য আমরা কাজ করছি। প্রতিদিনই দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ধরাও হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সবাইকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। অনিয়মের যেকোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবো।