রাজধানি ঢাকার হুমায়ুন রোডের পানির পাম্প, পাশের বাবর রোড, লালমাটিয়ার আড়ংয়ের পেছনের কলোনি, কল্যাণপুর ১ নম্বর এবং মিরপুর বাঙ্লা কলেজ ওয়াসা অফিস কম্পাউন্ডের পানির পাম্পসহ অন্তত ৪০০ পাম্পে, ক্লোরিন মিশিয়ে পানি শোধনের পর এই পানি সরবরাহ করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা করা হয় না।।
গভীর নলকূপের পানির মান তুলনামূলক ভালো হলেও এতে নানা ক্ষতিকর উপাদান থাকে। সেগুলো ধ্বংস করে এই পানিকে পানযোগ্য করে তুলতে তাতে পরিমিত ক্লোরিন মেশানো হয়। নিয়মানুযায়ী, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় ক্লোরিন মিশিয়ে পাইপলাইনে সরবরাহ করার কথা। যদিও ঢাকা ওয়াসার নয় শতাধিক পানির পাম্পের অন্তত চারশ’ পাম্পেই ক্লোরিন না মিশিয়ে পানি সরবরাহ করা হয়। কিছু পাম্পে এটি মেশানোর যন্ত্রপাতি থাকলেও অনেক সময়ই কেন্দ্র থেকে ক্লোরিন সরবরাহ করা হয় না। তাই পাম্প অপারেটররা ক্লোরিন ছাড়াই পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করেন। তাই উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়েই দূষিত থেকে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসার পানি।
গভীর নলকূপের পানির মান কিছুটা ভালো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জীবাণু থেকে যায়। এসব জীবাণু পেটে গেলে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েডসহ নানা রোগ হতে পারে। আবার সরবরাহ লাইনেও অনেক লিকেজ থাকতে পারে। সেখান দিয়েও নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ লাইনে ঢোকে। পানির এসব ক্ষতিকর জীবাণুকে নিষ্ফ্ক্রিয় করতে গভীর নলকূপের পানিতে কিছুটা হলেও ক্লোরিন মেশাতে হয়। এ জন্যই ওয়াসার পাম্পগুলোতে ক্লোরিন সেটআপ থাকা প্রয়োজন। তা ছাড়া এই ক্লোরিনও হতে হবে মানসম্পন্ন। না হলে আরও ঝুঁকিতে পড়বেন ব্যবহারকারীরা।
দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা ওয়াসার পানির মান নিয়ে নগরবাসীর সন্দেহ ও আশঙ্কা রয়েছে। তাই না ফুটিয়ে পানি পান করার সাহস কেউই দেখান না।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে। টিআইবি বলেছে, ঢাকা ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করতে নগরবাসীকে প্রতি বছর ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হয়। এরপর পানির মানহীনতায় অতিষ্ঠ হয়ে জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান সম্প্রতি ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত পান করাতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দ্বারেই হাজির হয়েছিলেন। এর পরও ওয়াসার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি যে পানি সরবরাহ করছে তা শতভাগ বিশুদ্ধ ও প্রতিটি ফোঁটাই সুপেয়। তবে স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমের নানা অনুসন্ধানে জানা গেছে, উৎপাদন পর্যায়েই দূষিত পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা।
ঢাকা ওয়াসায় বর্তমানে ৯০৬টি গভীর নলকূপ রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির মানও সব ক্ষেত্রে সমান নয়। আয়রনসহ অনেক ক্ষতিকর উপাদানও থাকে এতে। পানির স্তর নেমে গেলে ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা আরও বাড়ে। রাজধানীর অনেক স্থানেই পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পাম্পগুলোর উৎপাদন ক্ষমতাও কমেছে। এসব পাম্পের উত্তোলিত পানিতে আরও বেশি জীবাণু থাকার আশঙ্কা থাকে। এ জন্যই প্রত্যেকটি পাম্পেই ক্লোরিন মেশানোর ব্যবস্থা থাকার কথা। অথচ সরজমিন গিয়ে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অভিযোগ আছে, ওয়াসার একটি অসাধু চক্র প্রয়োজনীয় ক্লোরিন সরবরাহ না করে সেই অর্থ আত্মসাৎ করে ফেলে। অনেক সময় ক্লোরিন শেষ হওয়ার পর পাম্প অপারেটররা বারবার তাগিদ দিলেও কেন্দ্র থেকে সরবরাহ করতে অনীহা প্রকাশ করা হচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমকে বলেন , যে ক্লোরিন সেটআপ দেওয়া হয়, সেটা ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ডের হওয়ার কথা। অথচ সরবরাহ করা হচ্ছে চীন থেকে আমদানি করা মানহীন সেটআপ। এই দুর্বল সেটআপে ব্যাক্টেরিয়া নির্মূল হচ্ছে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ের তদারককারী ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম অপারেশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ওয়াসার পানি শোধনে ক্লোরিন কেন ব্যবহার করা হয়, ক্লোরিনের কাজ কী, সেটা ওয়েবসাইটেই পাওয়া যায়। আর কতকগুলো পাম্পে ক্লোরিন মেশানোর ব্যবস্থা আছে, সেসব তথ্য দেওয়ার অধিকার তার নেই। তবে যেকোনো তথ্য ঢাকা ওয়াসার জনতথ্য বিভাগ থেকে জানতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার জনতথ্য বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমক জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত তথ্য তার কাছেও নেই। এটা জানতে হলে সময়ের প্রয়োজন।
স্বদেশ নিউজ২৪ ডটকমের বিভিন্ন অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা গেছে যে, ধানমণ্ডির ৩ নম্বর রোডের লেকপাড় ওয়াসা পাম্পের পানিতে ক্লোরিন না মিশিয়েই সরবরাহ করা হচ্ছে। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পাম্পে কোনো সেটআপই নেই। ডিঙ্গি রেস্টুরেন্ট এবং তেজগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পশ্চিম পাশের পাম্পেও ক্লোরিনের সেটআপ নেই।
বাসাবো জিরানী খাল, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, বকশীবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, লক্ষ্মীবাজার, ইসলামবাগ, বেড়িবাঁধ ললিথ, নর্থসাউথ রোড, নাজিরাবাজার, বাংলাদেশ মাঠ, বেগমবাজার, দক্ষিণ পাইকপাড়া এবং দারুস সালাম পানির পাম্পসহ অনেক পাম্পেই ক্লোরিন না মিশিয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কাওলা ২ নম্বর পাম্পের একজন কর্মচারী বলেন, দু’মাস হলো সেটআপ নষ্ট হয়ে গেছে। কমপ্লেন দিয়েছি। কিন্তু কাজ করে না। বলে দেখতে আসবে। কিন্তু কেউ আসে না। এভাবেই চলছে ঢাকা ওয়াসার পাম্প গুলোর পানি সরবরাহ।