সোনালী সময়ের বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস জাভেদ। বিশেষ করে ফোক ফ্যান্টাসি সিনেমার অন্যতম প্রিয়মুখ তিনি। যাকে জাভেদ নামেই সবাই চেনেন। এই অভিনেতা শুধু অভিনয়েই দক্ষ নন, নৃত্যেও রয়েছে তার অসাধারণ দখল। নৃত্য পরিচালনার মধ্যদিয়েই তার দেশীয় সিনেমায় অভিষেক ঘটে। ৮০ থেকে ৯০ দশকে যেসব সিনেমা নির্মিত হয়েছে, সেসবের প্রত্যেকটিতেই তার নির্দেশনায় অন্তত একটি করে হলেও নাচ রয়েছে। সিনেমায় তার অভিনয়, নৃত্য আর তলোয়ারের যুদ্ধ দারুণভাবে ফুটে উঠতো। শত্রুকে পরাজিত করে রাজকুমারী নিয়ে সিনেমার শেষ দৃশ্যে যখন পর্দায় উপস্থিত হতেন তখন দর্শকরা করতালিতে হল মুখরিত করে তুলতেন। ‘নিশান’ সিনেমায় তার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে আজও। তৎকালীন সে সময়ের সিনেমাবোদ্ধারা মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিশান’ যদি নকল ছবি না হতো তাহলে জাভেদ তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হতেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, সেই সময় এ ছবি নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। তার অভিনয়ে ‘মালকা বানু’ ছবিটি সেই সময় সুপারহিট হয়। লোককাহিনী নিয়ে নির্মিত এ ছবির একটি গান ‘মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ের বাধ্য বাজেরে’ বহুল জনপ্রিয় হয়। নায়িকা শাবানার বাবা ফয়েজ চৌধুরী এ ছবির পরিচালনা করেন। গুণী এই অভিনেতার কাছে সিনেমায় তার শুরুর দিককার অভিনয় জীবনের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, তার জন্ম আফগাগিস্তানের পেশোয়ারে ১৯৪৪ সালে। পরে সেখান থেকে পাঞ্জাবে চলে আসেন তার পরিবার পরিজন। তার পিতা রাজা মুহাম্মদ ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময় চাইতেন তার ছেলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগ দিক। কিন্তু জাভেদ সেই দিকে মনোযোগ দেননি। তার মন সবসময় সিনেমার রঙিন দুনিয়ায় ঘুরপাক খেতো। স্বপ্ন দেখতেন হিন্দি সিনেমার নায়ক দিলীপ কুমার ও প্রেমনাথের মতো অভিনয় করার। ১৯৬৩ সালে তিনি তার মাতৃভূমি ছেড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) চলে আসেন সিনেমায় নিজের ভাগ্যকে পরীক্ষা করতে। ভিনদেশি মাটিতে তাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। নৃত্য পরিচালক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু নায়ক হিসেবে তার সুযোগ হয় উর্দু ছবি ‘নয়া জিন্দাগী’ দিয়ে। এটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। কিন্তু জাভেদের জনপ্রিয়তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ‘পায়েল’ ছবিতে। জনপ্রিয় নায়িকা শাবানার বিপরীতে জুটি করে ‘পায়েল’ সুপারহিট হয়। ১৯৬৬ সালেই জাভেদের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি হয়ে উঠেন বাংলার লাখো সিনেমাপ্রেমিকের প্রিয়মুখ। ১৯৭৪ সাল ছিল তার অভিনয় জীবনের উজ্জ্বল সময়। একে একে তিনি অভিনয় করেন ‘মালকা বানু’, ‘অনেক দিন আগে’, ‘শাহজাদী’, রাজকুমারী চন্দ্রভান’, ‘কাজল রেখা’, ‘নরম গরম’, ‘তিন বাহাদুর’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’সহ অসংখ্য ছবিতে। অনেক জনপ্রিয় গানের নৃত্যপরিচালকও ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ‘মনের এ ছোট্ট ঘরে আগুন লেগেছে হায়রে’, ‘চাকভূম চাকভূম চাঁদনী রাতে’, ‘মালকা বানুর দেশেরে বিয়ের বাজনা বাজেরে’সহ অসংখ্য গানে তিনি নৃত্য পরিচালনা করেছেন। জাভেদ তার জীবনের অনবদ্য অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছিলেন ‘নিশান’ ছবিতে ‘কালু’ চরিত্রে। বাংলা সিনেমায় যে ক’জন অভিনেতা দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাদের মধ্যে জাভেদের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় অনেক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল তাকে। সদালাপী সজ্জন এই অভিনেতা বর্তমানে উত্তরায় নিজ বাড়িতে অনেকটা অলস সময় পার করছেন। এই সময়ে তার ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। অবসর আর অবসর। নামাজ-কালাম আর পরিবার নিয়েই সময় কেটে যায়। চিরসত্য এটাই- একটা সময় সবাইকে অবসরে যেতে হয়। এটাই নিয়তি। তবে প্রতিটি পেশায় অবসর কথাটা প্রযোজ্য হলেও শিল্পীদের বেলায় সেটা প্রযোজ্য নয়। কারণ, আমরা শিল্পীরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৃজনশীল কর্মে লিপ্ত থাকতে চাই। শিল্পীদের কোনো পেনশন নেই। একসময়ের কর্মক্ষেত্র এফডিসিতে যাওয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে জাভেদ বলেন, বর্তমান ঢাকার রাস্তায় যে ট্রাফিক জ্যাম থাকে, মন চাইলেও সে কথা ভেবে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু চলচ্চিত্রের বিশেষ উৎসবগুলোতে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করি। অবশ্য আমাদের সময়ের অনেকেই আজ নেই। এফডিসিতে গেলে পুরানো সহশিল্পীদের কথা মনে পড়ে যায়। আজকের যে তরুণ শিল্পীরা রয়েছেন, সবাই আমাকে সম্মান দেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন। সবসময় এই নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের প্রতি আমার স্নেহ ও দোয়া থাকবে। তখনকার সব জনপ্রিয় নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন এই গুণী শিল্পী। তাদের সঙ্গে অভিনয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে জাভেদ বলেন, আমি তো শাবানা, ববিতা, কবরী, অলিভিয়া, অঞ্জুঘোষ, রোজিনা, নতুন, সুচরিতা প্রমুখের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছি। সত্যি বলতে কি, সবারই নিজস্ব অভিনয়ের স্টাইল থাকে। শাবানা, কবরী রাজরাঙা বধূ চরিত্রে অতুলনীয়। আবার ববিতা, অলিভিয়া শহরের মডার্ন মেয়ের চরিত্রে আনপ্যারালাল। এসবের বাইরে সবাই আমরা বন্ধু ও ভাই-বোনের মতো এক পরিবারের ছিলাম। এফডিসিই ছিল আমাদের সেকেন্ড হোম। আমাদের রুটি-রুজি, যশ-খ্যাতি সবই এই চলচ্চিত্র আমাদের দিয়েছে। বর্তমানে চলচ্চিত্র যে সময় পার করছে তা দেখে সত্যিই কষ্ট লাগে। আমি অবশ্য আশাবাদী মানুষ, অবশ্যই এই চলচ্চিত্র মাধ্যমটা আবার সোনালী অতীতের মতো ঘুরে দাঁড়াবে। আবার শিল্পী, পরিচালক, কলাকুশলীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠবে এফডিসি।