আফসার ওরফে জাফর সাদেক (৩৫), পারভীন আকতার (৩০), সুজিত কুমার নাথ (৪৫) ও ইকবাল হোসেন (৪০)। ওরা সবাই সংঘবদ্ধ শিশু চোরচক্রের সদস্য। চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানার পুলিশ সম্প্রতি তাদের গ্রেপ্তার করেছে। নগরীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ফুটপাথে থাকা হতদরিদ্রদের শিশু সন্তান চুরি করে ওরা। পরবর্তীতে নিঃসন্তান দমপতিদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকায় এসব শিশুকে বিক্রি করে দেয়। কোটিপতি হওয়ার নেশা থেকে এই পেশা বেছে নেয় চক্রটি। গ্রেপ্তারের পর চক্রের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এমন তথ্য দেয় বলে জানান, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান। তিনি জানান, এ চক্রের সঙ্গে জড়িত নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালের নার্স, আয়া, নিরাপত্তারক্ষীসহ বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীরা।
যারা চমেক হাসপাতাল থেকে মৃত নারীদের ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে শিশুটির মা মারা গেছে বলে জাল কাগজপত্র তৈরি করে চোরাই শিশুদের দত্তক দেয়। মেহেদী হাসান বলেন, বাচ্চা চুরি করে চুক্তির মাধ্যমে নিঃসন্তান দমপতির কাছে বিক্রি করে এমন চক্রের সন্ধান পাই আমরা। পরে অভিযান চালিয়ে শিশু চোরচক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সুজিত কুমার নগরীর মেহেদিবাগের ন্যাশনাল হাসপাতাল ও সিগমা ল্যাবের রেডিওলজি বিভাগের টেকনোলজিস্ট। জাফর সাদেকও একসময় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে চাকরি করতো। ওই চাকরির সুবাদে চমেক হাসপাতাল ও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের আয়াদের সঙ্গে তার সমপর্ক হয়। আর তাদের মাধ্যমে শিশু চুরির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে জাফর সাদেক। কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহসীন জানান, গত ২৭শে মে নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় শিশুপুত্র কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন শেফালী বেগম। এ সময় চোরচক্রের সদস্য ইকবাল তার কোলের শিশুকে নতুন জামা কিনে দেয়ার কথা বলে তাদের রেয়াজুদ্দিন বাজারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কৌশলে দুই মাসের শিশু মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে পালিয়ে যায় ইকবাল।
এ ঘটনায় শেফালী বেগম ২৮শে মে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলা তদন্তের সূত্রে ধরে শনিবার বিকালে কক্সবাজারের কলাতলী থেকে প্রথমে আফসার এবং পরে নগরীর মেহেদীবাগে ন্যাশনাল হাসপাতালের সামনে থেকে সুজিত এবং নগরীর অক্সিজেন এলাকার সৈয়দপাড়ায় এক বাসা থেকে পারভীনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যমতে, নগরীর দামপাড়ায় পল্টন রোডে জনৈক পবন কান্তি নাথের বাসা থেকে চুরি যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। নিঃসন্তান পবন কান্তি নাথ এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় জাফরের কাছ থেকে শিশুটিকে কিনে নেন। শিশুটিকে দত্তক নেয়ার সময় জাফরের সঙ্গে ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে পবনের চুক্তিও হয়। পুলিশ জানায়, দুইমাস আগে ইপিজেড থানায় একটি শিশু চুরির মামলায় মো. ইকবাল হোসেন (২৮) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশকে সে জানায়, ইকবাল ও আফসার দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় থাকে। রোগীর রক্ত লাগলে কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তারা টাকার বিনিময়ে সহযোগিতা করে। সেই ফাঁকে শিশু সন্তান চুরির কাজ করে। তারা হাসপাতালে শুধু নবজাতক নয়, রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে আসা শিশু সন্তানদেরও চুরি করে নিয়ে যায়। শনিবার গভীর রাতে তাদের অবস্থান জেনে কক্সবাজার কলাতলী থেকে আফসারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সে জানায়, এ পর্যন্ত সে ৭-৮টি বাচ্চা চুরি করেছে। প্রতিটি বাচ্চা বিক্রি করে সে ১০ হাজার টাকা করে পেয়েছে।
কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বলেন, শেফালীর বাচ্চাটি চুরি করে ইকবাল ও আফসার নামে দুজন। এরপর শিশুটিকে পারভীনের হেফাজতে রাখা হয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষায় দেখা যায়, ইকবাল বাচ্চাটিকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আফসার ও ইকবালের সঙ্গে হাসপাতালের আয়া-নার্স এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারীদের ভালো যোগাযোগ আছে। হাসপাতালে অনেক নিঃসন্তান নারী আয়া-নার্সদের কাছে দত্তক নেয়ার জন্য বাচ্চা চান। তখন আয়া-নার্সরা আফসার ও ইকবালদের মতো দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ চক্রটি দুইভাবে বাচ্চা সংগ্রহ করে। প্রথমত, অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের পর প্রসব করা বাচ্চা তারা নিয়ে নেয়। দ্বিতীয়ত, তারা বাচ্চা চুরি করে বিক্রি করে।
মোহাম্মদ আলীর বাবা আবদুল গাফফার জানান, আমি একটা ছেলের জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। আর সেই ছেলেকে হারিয়ে আমি আর তার মা পাগলের মতো হয়ে পড়ি। আজ প্রায় ছয় মাস পর আমরা বাচ্চাকে ফিরে পেয়েছি। এজন্য পুলিশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
মা শেফালী বলেন, গত ২৭শে মে বিকালের দিকে কাজীর দেউড়ি এলাকায় আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে আমার বমি হলে ইকবাল আমাকে পানির বোতল কিনে দেয়। ওই পানি খাওয়ার পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তখন সে আমার ছেলেকে নিয়ে যায়। আমার ছেলেকে আমি অনেকদিন পর ফিরে পেয়েছি। এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।
প্রসঙ্গত, আব্দুল গাফফারের বাড়ি সিলেট। পেশাগত কারণে তিনি চট্টগ্রামে থাকেন। তিনি একজন গাড়িচালক। তার প্রথম সংসারে তিন কন্যা সন্তান হওয়ায় পুত্র সন্তানের জন্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শেফালীকে বিয়ে করেন। ওই সংসারে তিনটি কন্যা সন্তানের পর আসে একটি পুত্র। যার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ আলী।
আলীর বয়স এখনো এক বছর হয়নি। এরমধ্যে চুরি হয় মোহাম্মদ আলী। শিশু চোরচক্রের হাতে পড়ে দুই মাসের আলী পায় নতুন মা-বাবা। নিজের মা-বাবার কোল খালি করে টাকার বিনিময়ে শিশুটিকে অন্যের হাতে তুলে দেয় চক্রটি।