দেশে করোনার সংক্রমণ থামেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ একইভাবে চলছে। প্রকৃত পক্ষে রোগী কমেনি। কয়েকগুণ রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। তাই শীত আসার আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের যুক্তি ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছিল। ফলে তারাও আবার কড়া বিধি-নিয়ম চালু করেছিল।
গ্রীষ্মকালের পর আবহাওয়া শীতল হলে এই মহামারি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।
দেশে সরকারি হিসাব মতে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার ছাড়িয়েছে। শনাক্তের সংখ্যা ৩ লাখ ২৯ হাজারের বেশি। করোনা শনাক্তের ১৮৫ দিনের মাথায় মৃত্যু ও শনাক্তের এই চিত্র দাঁড়িয়েছে। দেশে ৮ই মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হয় আর প্রথম মৃত্যু ১৮ই মার্চে। প্রথম থেকেই করোনার থাবা ঢাকাতে। হটস্পট ছিল রাজধানী। দিনে দিনে সারা দেশে ছড়ালেও রাজধানীতেই অর্ধেকের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো শিথিল হওয়ায় পরিস্থিতি রাজধানীতে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। এখন একে একে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে দেয়া হচ্ছে। কেবল মুখে মুখে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, মানুষের মধ্যে সার্বজনীনভাবে মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়ানো এবং পরীক্ষা ও আইসোলেশনের মতো স্বাস্থ্যবিধির কঠোর প্রয়োগের ওপর এ রোগের বিস্তার অনেকটা নির্ভর করবে। এসব মানতে মানুষকে বাধ্য করতে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করতে হবে।
করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনো টিকা না আসা পর্যন্ত এ মহামারি শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম উল্লেখ করে আগামী শীতকালে বাংলাদেশে এ ভাইরাসটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, ভিটামিন ডি এর অভাব এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়সহ শীতকালে অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগের লক্ষণ দেখা দেয় বলে এ সময় মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে আরো বেশি সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির অন্যতম সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, করোনার সংক্রমণের গতি আগের মতোই আছে। আমাদের এখানে দ্বিতীয় ওয়েভ হয়নি। যেটা ইতালিতে হয়েছিল। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক পরতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। হাঁচি, কাশি হলে রুমাল বা কনুই ব্যবহার করতে হবে। তার আশঙ্কা শীতকালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, কেননা বছরের এ সময়টাতে মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত আরো অনেক ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় রোগের লক্ষণ দেখা যায়। তিনি বলেন, শীতে তাপমাত্রা ও কম আর্দ্রতা করোনাভাইরাসকে আরো বেশি সময়ের জন্য বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেবে। সেই সঙ্গে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে করোনাভাইরাসটি মানুষের ওপর আরো বেশি প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, শীতে প্রবীণ ব্যক্তি ও শিশুদের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরো মারাত্মক হবে।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, কার্যকর প্রোগ্রামের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের প্রচেষ্টা আরো জোরদার করতে হবে। লুকিয়ে থাকা করোনা রোগীদের শনাক্ত করতে ও আক্রান্তদের আইসোলেশনের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রাকে কমাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ এই বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে এখনও করোনার প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি। সংক্রমণ একইভাবে চলছে। প্রকৃত পক্ষে রোগী কমেনি। কয়েকগুণ রোগী অশনাক্ত থেকে যাচ্ছেন। নানা জরিপ করলে বোঝা যেতো সঠিক সংখ্যা। ফলে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এখানে বিজ্ঞান বিমুখ কাজ হওয়ার কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জনগণ ম্যাকি নিরাপত্তা বোধের মধ্যে আছে। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন জনগণ। তিনি মনে করেন, করোনার লক্ষণগুলো শীতজনিত রোগের মতো। এটি মূলত শীতের একটি রোগ। যাদের শ্বাসনালী সমস্যা থাকে তাদের করোনার কারণে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এর অনেকগুলো স্ট্রেন আছে যা গ্রীষ্ম ও বর্ষার মৌসুমে বেঁচে থাকতে পারে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কিছু স্ট্রেন শীতকালে তীব্র ও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ের ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য এই বিশেষজ্ঞ। তাই, আমাদের এখনই পরিকল্পনা করা উচিত যাতে শীতকালে আমরা ভাইরাসকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র মতে, এ বছর মার্চ মাস পর্যন্ত শীত মৌসুমে তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯৩০ জন। যা আগের বছর ছিল ৮২০ জন। ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৬৪৯ জন, ২০১৬-১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০১০ জনে এবং ২০১৫-১৬ সালে ছিল মাত্র ১৪১ জন।
এদিকে, গতকাল স্বাস্থ্য অধিপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনা বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৩৬ জন মারা গেছেন। দেশে এখন পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৫৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে এক হাজার ৮৯২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ২৯ হাজার ২৫১ জন শনাক্ত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৬৯ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং মৃত্যু হার ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ২৩৬ জন এবং এখন পর্যন্ত ২ লাখ ২৭ হাজার ৮০৯ জন সুস্থ হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ১৪২টি নমুনা সংগ্রহ এবং ১৪ হাজার ৯৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ১৯ জন পুরুষ এবং ১৭ জন নারী। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৫৩ জন পুরুষ এবং ৯৯৯ জন নারী মারা গেছেন। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরের উপরে ২২ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৬ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৪ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২ জন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ২ জন রয়েছেন।
বিভাগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে ১৬ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, রাজশাহীতে ২ জন, খুলনায় ৮ জন, বরিশালে ২ জন, সিলেটে ১ জন এবং রংপুরে ১ জন রয়েছেন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে ৩৫ জন এবং বাসায় ১ জন মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ৩৬৩ জনকে। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১৮ হাজার ৯০৭ জন। আইসোলেশন থেকে ২৪ ঘণ্টায় ৬২৭ জন এবং এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার ২২৬ জন ছাড় পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত আইসোলেশন করা হয়েছে ৭৫ হাজার ১৩৩ জনকে। প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টিন মিলে ২৪ ঘণ্টায় কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে ১ হাজার ৬২৫ জনকে। কোয়ারেন্টিন থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৬৬৬ জন এবং এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৬ জন ছাড় পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৩৯৬ জনকে। এখন কোয়ারেন্টিনে আছেন ৫২ হাজার ৮৫ জন।