চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ও রপ্তানি নতুন কিছু নয়। এসব চালান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে ধরাও পড়ে কাস্টম কর্মকর্তাদের হাতে। কিন্তু সেই মিথ্যা ঘোষণায় কেউ অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে আসবেন, তা ছিল কাস্টম কর্মকর্তাদের ধারণারও বাইরে। এ কাজটি করেছেন চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা রাজীব বড়ূয়া। পাঠিয়েছেন ইতালির রোম থেকে। কিশোরকাল থেকে নানা অপরাধে হাতেখড়ি এই রাজীব বড়ূয়ার। জড়িত ছিলেন যুবদলের রাজনীতিতে। যুবদল ক্যাডার হিসেবে ‘নামডাকও’ ছিল তার। বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে একাধিক। পুলিশের তাড়া খেয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইতালি।
চলতি মাসের শুরুতে ফিরেছেন ইতালি থেকে। অস্ত্রের চালান জব্দের ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা হওয়ার পর তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ইতালি থেকে অস্ত্রের চালানটি পাঠান রাজীব বড়ূয়া। প্রাপকের ঠিকানা দেন নিজের বাল্যবন্ধু আয়কর বিভাগের কর্মচারী মজুমদার কামরুল হাসানের। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে তার কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য পায়নি তারা। রাজীবকে গ্রেপ্তার করতে পারলে উদ্ঘাটন হবে মিথ্যা ঘোষণায় দেশে অস্ত্র আনার আসল রহস্য। তবে এর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কামরুলকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
কে এই যুবদল ক্যাডার রাজীব বড়ূয়া :রাজীব বড়ূয়ার বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার উড়কিরচর ইউনিয়নের আবুরখীলের উত্তর ঢাকাখালী গ্রামে। তার বাবা ফণিভূষণ বড়ূয়া ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা গীতা রানী বড়ূয়া ছিলেন কাস্টমের কর্মকর্তা। কর্মসূত্রে তারা থাকতেন চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে সিজিএস কলোনির সরকারি বাসায়। মা অবসরে যাওয়ার পর সে বাসা ছেড়ে দেন তারা। রাজীব বড়ূয়ার বেড়ে ওঠা সিজিএস কলোনিতে। পড়াশোনা করেন আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুলে পড়া অবস্থায় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। পরে যুবদলের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নগরের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ ও বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় নানা অপরাধ করে বেড়াতেন রাজীব। বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান। এরপর লিবিয়া হয়ে ইতালি পাড়ি জমান তিনি। সর্বশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন রাজীব বড়ূয়া। সাম্প্রতিক সময়ে তাকে আগ্রাবাদের সিজিএস কলোনি এলাকায় দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ‘রাজীব বড়ূয়া একাধিকবার নানা অপরাধে জেলও খেটেছেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নগর পুলিশের সন্ত্রাসী তালিকায়ও তার নাম ছিল। সে কার জন্য এবার অস্ত্র নিয়ে এসেছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে বন্দর থানার ওসি জাহেদুল কবির সমকালকে বলেন, ‘রাজীব বড়ূয়াকে গ্রেপ্তার করতে পারলে সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।’
উড়কিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবদুল জব্বার সোহেল সমকালকে বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্য থেকে রাজীব বড়ূয়ার খবর নেওয়া হচ্ছে। তার বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলাম। সেখানে তাদের জায়গা থাকলেও কোনো বাড়ি নেই। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন তারা চট্টগ্রাম শহরে থাকেন। ‘
অসৎ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সর্বনাশ! :আটক অস্ত্রের চালানে প্রাপকের ঠিকানা ছিল আয়কর বিভাগের কর্মচারী মজুমদার কামরুল হাসানের। রাজীব বড়ূয়া ও কামরুল বন্ধু। দুইজনের বেড়ে ওঠা নগরের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে। কামরুল কর অঞ্চল-১-এর সার্কেল-১২ তে উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত সোমবার মধ্যরাতে তাকে নগরের হালিশর থানার আই ব্লকের খালপাড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কামরুল নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার কামালপুর মজুমদার বাড়ির গোলাম ছাত্তার মজুমদারের ছেলে। পরিবার নিয়ে থাকতেন নগরের আগ্রাবাদের সিজিএস কলোনির সরকারি বাসায়।
গ্রেপ্তার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা নগর পুলিশের ডবলমুরিং জোনের সহকারী কমিশনার আরিফ হোসেন বলেন, ‘কামরুল হালিশহরে তার শ্বশুর বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বন্দর থানায় তাকে হস্তান্তর করা হয়।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কামরুল জানিয়েছে, একটি গৃহস্থালি পণ্যের চালান আসবে এটি তাকে বলেছিল রাজীব। রাজীব দেশে আসার আগে বুকিং দিয়ে এসেছিলেন। চালানে তার জন্য একটি ব্লেন্ডারও ছিল। কামরুলের সঙ্গে রাজীব বড়ূয়ার হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে অস্ত্রের চালানের বিষয়ে কামরুল কিছু জানত না বলে মনে হয়েছে।’