হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ভোক্তার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পেঁয়াজ। প্রতিদিনের রান্নায় বহুল ব্যবহৃত মসলাজাতীয় এ পণ্যটির দাম কেজিতে দুই থেকে পাঁচ টাকা বাড়লে তার বড় চাপ পড়ে ভোক্তাদের সংসার খরচে। গত দুই সপ্তাহে পণ্যটির দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় আরও চাপে পড়েছে ভোক্তারা। রাজধানীর
বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। ঢাকার বাইরে পাবনা, রংপুর, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি বাজারেও পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এমনকি ভারতীয় পেঁয়াজেও স্বস্তি মিলছে না। এই পেঁয়াজ খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীর বাজারগুলোয় খুচরা পর্যায়ে প্রকার ও মানভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। সাধারণত দেশি পেঁয়াজের তুলনায় ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এবার ভারতীয় পেঁয়াজেও হাত দিতে পারছে না ভোক্তারা।
মালিবাগ বাজারের মেসার্স গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ হোসেন আমাদের সময়কে জানান, গতকাল এ বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। ভালো মানেরটা ৬০ টাকা কেজি। দুই সপ্তাহ আগেও ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছি। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম এখন অনেক বেশি। প্রতি কেজি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
মাতুয়াইল সাদ্দাম মার্কেট বাজারেও দেশি পেঁয়াজ একই দামে বিক্রি হচ্ছে বলে আমাদের সময়কে জানান মিলন জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মিলন মিয়া। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগেও দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। বাজারে এখন ভালো মানের পাবনার পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকার নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না। ঈশ্বরদী, চুয়াডাঙ্গার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। এর কমে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকার মধ্যে সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। মোকামে ভারতীয় পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও দাম বেশি। তাই এ বাজারে ভারতীয় নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে না আজ।
এর আগে গত বছর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে এক লাফে কেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে খুচরায় পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা হয়। সে সময়ও পেঁয়াজের দামে ভুগতে হয়েছে ভোক্তাদের।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো. নূর ইসলাম ও আবদুল খালেক জানান, গেল বছর অক্টোবরে দাম হঠাৎ বাড়লেও ডিসেম্বর থেকে তা কমে আসে। দুই সপ্তাহ ধরে বাজার আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। গতকাল বুধবার এ বাজারে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ প্রকারভেদে ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা কেজি বিক্রি হয়। আমদানি কমে যাওয়ায় ভারতীয় পেঁয়াজ আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বুধবার এ পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হয় ৫২ থেকে ৫৪ টাকা পর্যন্ত।
রাজধানীতে পেঁয়াজের বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের আজমেরী ভা-ারের পাইকারি ব্যবসায়ী তপু সেন জানান, এখানকার পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ তথ্যও বলছে, দেশি পেঁয়াজের দাম এক মাসের ব্যবধানে ৫৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং বছরের ব্যবধানে ৭২ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। যদিও বাজারে বেড়েছে আরও বেশি। অন্যদিকে টিসিবির হিসাবে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম মাসের ব্যবধানে ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়লেও বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।
শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাজেদ আমাদের সময়কে বলেন, বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ এখন শেষ। হালি পেঁয়াজ উঠতে আরও ২০-২৫ দিন সময় লাগবে। তার ওপর মাঝে অসময়ে বৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে খরচ বেশি হওয়ায় আমদানিকারকরা ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি করছেন কম। তাই হঠাৎ দাম বেড়ে গেছে। বাজারে হালি পেঁয়াজ উঠলে দাম কমে আসবে বলে আশা করেন তিনি।
জানা গেছে, পেঁয়াজের রাজধানী পাবনাতেও বিভিন্ন হাটবাজারে মূলকাটা বা কন্দ পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। পাবনার অন্যতম বৃহৎ পেঁয়াজের হাট সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম হাট, করমজা হাট, কাশিনাথপুর, সুজানগর এবং সদর উপজেলার হাজীরহাটে পাইকারিতে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও যা বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১ হাজর ২০০ টাকা মণ দরে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে রংপুরের পাইকারি বাজারেও দাম কেজি প্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। আর খুচরায় বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে রংপুরের সর্ববৃহৎ রংপুর সিটি বাজারে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা ধাড়া (৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি কেজি ২৮ থেকে ৩০ টাকা পড়েছে।
রংপুর সিটি বাজার আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমদানি না থাকায় গত সপ্তাহে ভারতীয় পেঁয়াজ রংপুরের বাজারে ছিল না। তার ওপর বৃষ্টির কারণে সময়মতো নতুন পেঁয়াজ তুলতে না পারায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
মাগুরা ও ফরিদপুরের পেঁয়াজের বাজারেও দাম বাড়তি। ফরিদপুরের সালথা ও নগরকান্দা, চরভদ্রাসন, সদরপুর, বোয়ালমারীসহ ৯ উপজেলায় কম-বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এসব এলাকার আড়তেও দাম বেড়েছে।
ফরিদপুরের সদরের মমিন খাঁর হাটের আড়তদার হাকিম ব্যাপারী বলেন, গত সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। আগে দেশি চাহিদা মেটাতে ভারতীয় পেঁয়াজের ওপর নির্ভরতা থাকলেও বর্তমানে দেশীয় উৎপাদন বাড়ছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে মোট ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হয়। পেঁয়াজের মোট উৎপাদন হয় ৩৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৮২ মে. টন। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এতে ৩৫ লাখ ৪ হাজার ২০০ মে. টন পেঁয়াজ উৎপাদন হতে পারে বলে আশা করছে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৯৬ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলারের পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। এ সময় আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৯৮ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলারের। পেঁয়াজ রপ্তানিতে বর্তমানে ভারতের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তা ছাড়া ভারতীয় কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণকারী সংস্থা ‘ন্যাপেড’ পেঁয়াজ রপ্তানিতে কোনো মূল্যও বাড়ায়নি। তার পরও বাজারে কেন দাম বাড়ছে জানতে চাইলে সরবরাহ সংকট ও আমদানি খরচ বৃদ্ধিসহ নানা কারণ দেখাচ্ছেন আমদানিকারকরা।
রাজধানীর পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাদ ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসায়ী মো. হাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে জানান, ভারত থেকে আমাদেরই এখন কিনতে হচ্ছে ২৮ টাকা কেজি দরে। গত সপ্তাহের শেষে ২৫ থেকে ২৬ টাকাতেও পাওয়া গেছে। বন্দর পার করে দেশে আনার পর কেজিপ্রতি খরচ হয় ৪৫ টাকা এবং ঢাকায় আনতে আরও তিন টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখন ঋণপত্র কম খোলা হচ্ছে। তাই দাম বাড়তি রয়েছে।
এদিকে খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানকার পাইকারি বাজারে ১৫ দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দেশি পেঁয়াজের দাম ৮ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ৬ টাকা বেড়েছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, ১৫ দিন আগেও দেশি কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে আসায় ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানিকারকরা পণ্যটির আমদানি কমিয়ে দেন। তখন দেশি পেঁয়াজের পাইকারি দাম ছিল কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা। আমদানি পেঁয়াজ ছিল ৪০ টাকা। গত মঙ্গলবার সকালে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৩৬-৩৮ টাকা কেজি। ভারতের নাসিক জাতের পেঁয়াজ ৪৬-৪৮ টাকা, মেহেরপুরের পেঁয়াজ ৩২ টাকা এবং মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৩৭-৩৮ টাকায় বিক্রি হয়।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা আমাদের সময়কে বলেন, আগে যেখানে বেনাপোল থেকে খাতুনগঞ্জে ১৩ টনের একটি ট্রাক পেঁয়াজ নিয়ে এলে ভাড়া দিতে হতো ২৮ হাজার টাকা। এখন দিতে হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শ্রমিক সংকট রয়েছে। সব মিলিয়ে পণ্যটির দাম বাড়ছে।
সংকট ছোট হলেও তা বড় করে দেখিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ ভাগ পচে যায়। এ কারণে কৃষকরা পানির দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের উৎপাদন খরচই উঠছে না। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা কম দামে পেঁয়াজ কিনে তা বাজারে নানা অজুহাতে চড়া দামে বিক্রি করছে। প্রশাসনের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় তারা অধিক মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সব সময়ই সুযোগের সন্ধান করেন। বিভিন্ন অজুহাতে বাড়তি মুনাফার ফন্দি আঁটেন। পণ্য সংকটে দাম বাড়তে পারে, তবে কোনো ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিয়ে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ এমন সময় অনেক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তারা সুযোগে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে স্বল্পসময়ের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা লোটেন। তার মাশুল দিতে হয় ভোক্তাদের।