জনতুষ্টিকে সামনে রেখে অর্থসঙ্কট সত্ত্বেও বড় বাজেট নিতে যাচ্ছে সরকার। তাই রেকর্ড ঘাটতি থাকছে আগামী অর্থবছরের (২০১৪-১৫) বাজেটে। বর্তমান অর্থবছরের বাজেট থেকে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতিই থাকবে ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৫ শতাংশ। এডিপি’র আকার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৫ জুন নতুন ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটটি অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি আকার ধরা হচ্ছে আট শতাংশ, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি অর্থবছরে এ হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ; কিন্তু এটি অর্জন করা সম্ভব হবে না। এখন সংশোধন করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশের ঘরে রাখার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। অন্য কিছু করা না হলে, বছর শেষে তা-ও অর্জন করা বেশ দুরূহ হয়ে পড়বে। অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বলছে, এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে ৬ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে যা ছিল সাত শতাংশ।
রাজস্ব আয় : ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির সম্ভাব্য প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব প্রাপ্তির আকার হবে প্রায় এক লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত কর থেকে পাওয়া যাবে পাঁচ হাজার ২১০ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তির উৎস থেকে আসবে আরো ২৮ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি’র অংশ হিসেবে এনবিআর থেকে রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী বাজেটে কর খাতে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কার করা হবে না। তবে ব্যবসায়ীদের চাপ থাকলে করপোরেট করের হারে পরিবর্তন হতে পারে। করের হার তেমন একটা না বৃদ্ধি করে এর আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে বেশি নজর দেবে সরকার।
বাজেট ঘাটতি : আগামী অর্থবছরের বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ব্যতীত) নির্ধারণ করা হচ্ছে ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৫ শতাংশ। এই ঘাটতির মধ্যে ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা মেটানো হবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে এবং বাকি ৪৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এই অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয় পত্র থেকে ঋণ। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনুদান ব্যতীত সামগ্রিক ঘাটতি রয়েছে ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা জিডিপির চার দশমিক ৬ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে যেয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেট বর্তমান সরকারের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং রাজনৈতিক কারণে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। জুন মাসে বাজেট ঘোষণা করা হলেও নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটি সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। ফলে বাজেটে জনহিতকর বা জনতুষ্টিমূলক অনেক প্রকল্প রাখা হবে, যাতে আগামী নির্বাচনে সরকারের পক্ষে একটি ইতিবাচক ফল দেখা যায়। তিনি বলেন, প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার এডিপিতে অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প রাখা হবে। তবে এর পাশাপাশি মানবসম্পদ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য), কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগে সর্বাধিক বরাদ্দ থাকবে। এর সাথে ছয় হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ থাকবে শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পেই।
সংশোধন করা হচ্ছে চলতি বাজেট : চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল বাজেট এখন আর বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। ফলে অর্থবছরের সাত মাসের মাথায় এটি কাটছাঁট শুরু করা হয়েছে। পুরো বাজেট থেকে কেটে ফেলা হচ্ছে ১১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটের আকার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ২২০ কোটি টাকা, যা মূল বাজেট থেকে ৬ শতাংশ কম। সরকারের বড় বিনিয়োগ কর্মসূচি এডিপিও হ্রাস করা হচ্ছে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কারণ সেটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ৩৩ শতাংশ, যা বিগত কয়েক বছরের চেয়ে কম। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও ভালো। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। কমানো হয়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও । বাজেটে এটির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত দশমিক ২ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও রাখা হচ্ছে ৭ শতাংশের ঘরে। ফলে চলতি ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজর ২২০ কোটি টাকা, যা মূল বাজেট অপেক্ষা ১১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা বা ৬ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটের আকার নির্ধারিত রয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৬ শতাংশ, মূল বাজেটে যা নির্ধারিত রয়েছে সাত দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ শতাংশ। এবারের বাজেটে এডিপি আকার নির্ধারণ করা রয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এটি ৫৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে।