রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় বসুন্ধরা সিটির সামনের রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা আফজাল। দেখলেন দূরে একটি রিকশা আসছে। এই ফাঁকে রাস্তাটা তড়িঘড়ি পার হতে গেলেন। এতেই ঘটল বিপত্তি। রিকশাটি ধারণার চেয়েও তিনগুণ গতিতে এসে তার ওপর উঠে গেল।
এরপর যা হবার তাই হলো। হাত-পায়ের বিভিন্ন জায়গায় মারাত্মকভাবে কেটে গেল। মাথায় চোট, ফুলে গেল। কোনো রকমে জীবন বাঁচিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। এরমধ্যে ফোন করে না পেয়ে বাসার লোকজন তো গুম-আতঙ্কে অস্থির।
দৃশ্য- ২ : কয়েক দিন আগের ঘটনা। মগবাজার মোড়ের কাছে বেশ হই চই। এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, একজনকে অচেতন অবস্থায় ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে লোকজন। তার সারা গা রক্তাক্ত। আঘাতের দাগ। অল্প সময়েই তার জ্ঞান ফিরে এলো। তাকে পাশের একটি ওষুধের দোকানের ডাক্তার ডেকে স্থানীয়রা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। এ রকম ঘটনা এখন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায়শই ঘটছে।
এসব রিকশার নেপথ্যের কাহিনীটি হল, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। প্রতিদিনই এ ধরনের ঘটনা এখন অহরহ শোনা যায়। পরিচিত ডাক্তারদের কাছে গেলেও এমন রোগি পাওয়ার সত্যতা মিলছে। ঢাকা শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে অহরহ চলাচল করছে এসব রিকশা।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহর এবং মফস্বলে এ ব্যাটারি রিকশা এখন প্যাডেল রিকশার স্থান নিয়ে নিয়েছে। অনেক শহরে এখন প্যাডেল রিকশা প্রায় বিলুপ্ত। ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই শহরের কোথাও না কোথাও ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণহানির মতো ঘটনা না ঘটলেও মারাত্মক জখম হচ্ছেন যাত্রী ও চালকরা। এসব দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালানো এবং ব্যাটারিচালিত রিকমার যান্ত্রিক ত্রুটি ও রিকশার সাথে যন্ত্রটির বেখাপ্পা সংযোজন।
রাজধানীর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও অর্থোপেডিক্স বিভাগের থেকে জানা গেছে, গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার আহতের ঘটনার অধিকাংশই ব্যাটারিচালিত রিকশার দুর্ঘটনার শিকার।
রিকশাগুলোর দূর্ঘটনায় পড়ার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো যে গতিতে চলে তাতে সামান্য ধাক্কা খেলেই কয়েক পলটি খেয়ে চালক এবং যাত্রী উভয়কেই মারাত্মকভাবে আহত করে। তবে এর সাথে যোগ হচ্ছে, হার্ড ব্রেক করলে, যাত্রী ছুটে সামনে পড়ে যাচ্ছে, কারণ যাত্রীরা খোলা রিকশায় বসছে যেখানে তার সামনে ধরার মত কিছু নেই। প্যাডেল রিকশাতেও একই সমস্যা আছে। কিন্তু প্যাডেল রিকশা যেহেতু খুব স্লো চলে, তাই হার্ড ব্রেক করলেও, চালকের সিট বা হুড ধরে ব্যালেনস করে নেয়া যায়, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই প্যাডেল রিকশাতেও হার্ড ব্রেক করলে, পড়ে গিয়ে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে, কিন্তু তা ভয়াবহ হয় না, কারণ গতি কম থাকে। দূর্ঘটনা এড়াতে এই রিকশার ব্যাপারে নীতিমালা ও রিকশা তৈরির প্রক্রিয়ায় কিছু গাঠনিক পরিবর্তন আনার দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন- প্রথমত, সব ব্যাটারি চালিত রিকশার জন্যে একটা চালকের সিটের সাথে লাগানো, সিটের আনুভূমিকভাবে একটা হান্ডেল বা বার বাধ্যতামূলক করে দেয়া, যেই হ্যান্ডেলটা যাত্রীরা সব সময়ে হাত দিয়ে ধরে রাখতে পারবে। এইটা করতে বেশী হলে ৫০০ থেকে ১০০ টাকা লাগবে। কিন্তু, এর ফলে যাত্রীরা চাইলেই হাত বাড়িয়ে সেই বারটা ধরে রাখবে এবং ব্রেক কষলেও সে ছুটে ছিটকে পরবে না, বারটা ধরে রাখার কারণে। দ্বিতীয়ত, গতি নির্ধারণ করে দেয়া এবং রিকশার সাথে একটা স্পিড মিটার লাগানোর আইন করে দেয়া, আবশ্যক করে দেয়া। এবং প্রয়োজনে একটা নির্দিষ্ট গতির ওপরে স্পিড বাড়ানোর প্রতিবন্ধক করে দেয়া। বুয়েট বা অন্য টেকনিকাল ইউনিভারসিটি এই ধরনের একটা রিকশা ডিজাইন করে, সরকারকে দেখাতে পারে।
ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার দুর্ঘটনা যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা চিন্তাও করা যায় না। প্রায় সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে। এসব বাতিল করা হবে নাকি নিবন্ধন দেয়া হবে? নিবন্ধন করা হলে কে করবে সিটি করপোরেশন নাকি বিআরটিএ? মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো নিদের্শনা নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ-নর্থ, উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ আবিদ হোসেন পরিবর্তনকে বলেন, ”ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে আমরা শুরুর থেকেই বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বন্ধের চেষ্টা করেছি। কিন্তু মালিকেরা প্রভাবশালী মহলের ব্যানারে নিজেদের একটি সমিতি গড়ে তোলে। তাদের প্রভাবে রিকশাগুলো রাস্তায় চলাচল করে। যেহেতু এ রিকশার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ দূর্ঘটানার শিকার হচ্ছিল, তাই আমরা অভিযান চালাচ্ছিলাম। কিন্তু এরপরই রিকশার মালিক সমিতি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তবে মহামান্য আদালত এই সংক্রান্ত রিট গতকাল খারিজ করে দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, ”মঙ্গলবার সকাল থেকে আমরা ঢাকা নর্থ ট্রাফিক বিভাগ অভিযান পরিচালনা করেছি। এই অভিযানে ১১০টি ব্যাটারি চালিত রিকশাকে আমরা ডাম্প করেছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
এদিকে রিকশার মালিকেরা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য ট্রাফিক বিভাগ থেকে বিশেষ কার্ডের মাধ্যমেই রিকশাগুলো রাজধানীর রাস্তায় চলাচল করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবিদ হোসেন বলেন, এগুলো ভুয়া কথা। তাদের কোনো কার্ড প্রদান করা হয়নি, বরং সিটি কর্পোরেশন থেকেও এগুলোকে কোনো লাইসেন্স দেয়া হয়নি। তাই এগুলো অবৈধ রিকশা। এবং এখন থেকে এসব রিকশা বন্ধে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাবে ট্রাফিক বিভাগ।