সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা কখনও ভাবিনি। কোন দিন প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি। তারপরও অনেকেই এই সব কথা ছড়িছেন। যার কোন ভিত্তি ছিল না । জেনারেল মইনকে নিয়ে অনেকের কৌতুহল রয়েছে। তিনি কোথায়, কেমন আছেন। এটা অনেকেই ভাসা ভাসা জানলেও খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই জানেন না তার সম্পর্কে। কারণ তিনি কোন আলোচনায় যেতে চান না। তেমন কারো সঙ্গে দেখাও করেন না। কথাও বলেন না। অনেকটা নীরবেই সময় কাটাচ্ছেন। এখানে নিউইয়র্ক শহরের প্রানকেন্দ্রেই থাকেন। তিনি ছাড়াও তার স্ত্রী থাকেন নিউইয়র্কে। আর ছেলে থাকেন ফ্লোরিডাতে। এই দুই সিটিতে আসা যাওয়ার মধ্যে আছেন।
নিউইয়র্ক সময় শনিবার বিকেলে তার সঙ্গে কথা হয়। কেমন আছেন জানতে চাইলে, জেনারেল মইন তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে একটা হাসি দিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমতে এখন অনেক ভাল আছি। মাঝে অনেক অসুস্থ ছিলেন, এখন কেমন? সেটা হয়েছিলাম। এখন আগের মতো অত খারাপ নয়। একটু ভালর দিকে। এই অসুস্থতা নিয়ে বেঁেচ উঠতে পারবো এটা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু আল্লাহ সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে যখন দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমান তখন সুস্থ অবস্থায়ই এখানে আসেন। কিন্তু আসার আগেও জানতেন না কি কঠিন রোগ তার শরীরে বহন করছেন। কতটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে তার জীবন। এখানে আসার কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারলেন কি কোন অবস্থায় রয়েছেন। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কঠিন এক অসুখের কথা তাকে চিকিৎসকের মুখ থেকে শুনতে হলো। প্রথম যেদিন রোগটার কথা শুনলেন সেদিন ভয়ও পেয়েছিলেন। কিন্তু ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। মনোবল কঠিন করেন। এরপর নিরন্তন লড়াই করে যান মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে।
এখন পুরোপুরি জয়ী হতে পারেননি। ক্যান্সারের সঙ্গে নিরন্তন লড়াই করে চলেছেন। তবে এখন আগের চেয়ে ভাল আছেন। জেনারেল মইনকে এক সময়ে যারা দেখেছেন তাদের এখন দেখে মেলাতে কষ্ট হবে তিনি এখন কতটা বদলে গেছেন। তার ওজন এখন ১৩৫ পাউন্ড। আগে মাঝখানে ওজন হয়েছিল মাত্র ১১০ পাউন্ড। তিনি গত দুই বছর প্রায় পুরো সময়টাই অসুস্থ ছিলেন। এখন একটু ভাল আছেন। তার অসুখের নাম বোনমেরু ক্যান্সার। এই ক্যান্সারের জন্য তাকে নিয়মিত কেমো নিতে হয়েছে। এখনও চিকিৎসা চলছে। এতোদিন থেরাপি নির্ভরই ছিল বেশিটা। সম্প্রতি তার চিকিৎসা চলছে ওরাল। এখন প্রতিদিনি ওষুধ খেতে হয়। বলেন, এখন অনেক অনেক ওষুধ খেতে হয়। যত দিন বেঁেচ আছি ওষুধ খেতে হবে। আগে কেমো নিতে হতো। এখন মুখের চিকিৎসার ওষুধ দিয়েছে। নিয়মিত প্রতিদিন ওষুধ খাওয়া ছাড়াও সিডিউল অনুযায়ী চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। এই জন্য অনেক সময়ও ব্যয় হয়। সময়েরতো সমস্যা নেই, এখন তো আর কিছুই করছেন না।
তিনি বলেন, সেটার জন্য না। এখানে চিকিৎসা নিতে অনেক সময় লাগে। ব্যয় বহুলও বটে। শরীরে এত বড় কঠিন অসুখ বাঁধিয়েছেন এটা কি একবারের জন্য টের পাননি? জেনারেল মইন বলেন, সেটা কখনো বুঝতে পারিনি। দেশে কাজের মধ্যে এত ব্যস্ত ছিলাম, যে নিজের শরীরের দিকে তাকানোর সময় ছিল না। এই কারণে ওই সময়ে কোন অসুখ দেখা দিলে ইগনোর করে গেছি।
অসুস্থতা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? না সেটা পাচ্ছি না। অনেক কঠিন সময় পাড় করেছি। এখন আর ভয় পাচ্ছি না। বরং আল্লাহর কাছে সব সময় এটাই হাজার শোকর করছি যে তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুস্থ করে তুলেছেন। আর কত দিন লাগবে পুরোপুরি সুস্থ হতে? তিনি বলেন, পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব নয়। ছয় বছর পর পর শরীরের ক্ষতিকারক জীবাণুগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। যত দিন বেঁেচ আছি, চিকিৎসা নিয়ে যেতে হবে। পুরোপুরি আর সুস্থ হওয়া সম্ভব হবে না।
চিকিৎসা নেয়া শেষ হলে দেশে ফিরবেন কি? জেনারেল মইন বলেন, কবে চিকিৎসা নেয়া শেষ হবে সেটাই আমি জানি না। তাই এই মুহুর্তে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছি না। সুস্থ হলে অবশ্যই দেশে যাবো। তবে দিনক্ষনটা এখন বলতে পারছি না। আপনাকে নিয়ে এত আলোচনা ও সমলোচনা কোনটিরই শেষ নেই, কেমন লাগে এই সব বিষয়? জেনারেল মইন বলেন, এটা যে যার মতো করেই করে। কেউ জেনে করেন, কেউ না জেনে করেন। কারণ সব কথাতো আর সবাই জানেন না। অনেকেই আবার শুনে শুনে করেন। মানুষের শোনা কথাতে অনেক ভুল থাকে। ওই সব শোনা ভুল কথাগুলো বলেন। ভুলে ভরা অনেক তথ্য সারাক্ষনই ভেসে বেড়াতে থাকে। তিনি বলেন, যে যার অবস্থা থেকে তাদের মতো করে বলেন। তখন তাদের ওই সব কথা শুনলে কখনো কখনো তাদের জন্য খারাপ লাগে যে তারা কত ভুলে ভরা তথ্য নিয়ে সেটা একজন আরেক জনকে পৌঁছে দেয়ার জন্য দৌঁড়ে বেড়ান। দেশেও এমন অনেক কথা ছড়ানো হয়েছে। যার অনেকগুলো মিথ্যে। প্রকৃত ঘটনাকি এটাতো আমি আমার শান্তির পথে বইয়ের মধ্যে লিখেছি। আরো কথা আছে। তাও লিখবো।
সবতো আর ভুল নয়? তিনি বলেন, সব ভুল কি ভুল না সেটা আমি বিচার করি না। কারণ প্রয়োজন হয় না। কেউ যদি কিছু বলে তাদের মুখতো আর আটকানো যাবে না। তাছাড়া আপনিতো জানেন আমি কেমন ধরনের মানুষ। কেউ একটা কথা বললেই সেটা নিয়ে আবার কথা বলতে যাবো এমনতো নয়। তারা সত্য মিথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে খাক। সেটা নিয়ে আমার চিন্তা করে লাভ নেই। আমি কি , কি করেছি, কি করতে চেয়েছি এটা আল্লাহতালা জানেন।
তিনি বলেন, মানুষের জানার মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুল হলো আমি নাকি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলাম। এই কথাটি অনেকেই অনেক ভাবে ছড়িয়েছেন। কিন্তু এর কোন ভিত্তি ছিল না। এটা শতভাগ মিথ্যে ও বানোয়াটা একটা প্রপাগান্ডা ছিল। আমি কোন দিন দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি। আমি যে প্রেসিডেন্ট হতে চাইনি, সেই কথা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদও জীবিত থাকতে দৈনিক মানবজমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও বলেছেন। তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, জেনারেল মইন কোন দিনে প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা আমাকে বলেননি। এমনকি তার ইচ্ছের কথাও আমাকে জানাননি। জেনারেল মইন বলেন, ইয়াজউদ্দিন সাহেব ঠিক কথাটিই বলেছিলেন। আমি প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে আর কাউকে না বললেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াজউদ্দিন সাহেব। তাকেতো আমার মনের কথাটা বলতে হতো। তাতো বলিনি। আসলে ওই ধরনের কোন কথা আমার মনেই ছিল না। ওই সময়ে অনেক শত্র“ তৈরি হয়েছিল তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে না পেরে অনেক কথা বলেছেন।
তাদের কারো কারো ইচ্ছে ছিল আমি সব দায়িত্ব নেই। অনেকে আমাকে অনুরোধও করেছেন। কিন্তু যখন দেখেছেন নেইনি। তখন তাদের ভাল লাগেনি। তারাও প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছেন। আপনার মনে তখন কি কথা ছিল? জেনারেল মইন বলেন, তখন আমার মনে একটাই কথা ছিল সেটা হলো যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচন করার জন্য সরকারকে সহায়তা করা। আর সেই নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত থেকে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে সহায়তা করা। আমি গণতন্ত্রের বাইরে কান চিন্তাই করিনি। এই কারণে ওই সময়ে যতটা দিনে গিয়েছে মনে হয়েছে কত দ্রুত দায়িত্বটা শেষ করে সরকার গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিবে। যে ট্রেনটা খাদে পড়ে গিয়েছিল সেটাকে সঠিক লাইনে তুলে দিতে পারবো। সেটা বেশ ভাল ভাবেই পেরেছি।
এখন কেমন মনে হচ্ছে? জেনারেল মইন বলেন, আমি সব সময় চেয়েছি দেশে গনতন্ত্র ছিল, থাকবে। এই কারণে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত থেকে গণতান্ত্রিক সরকার আবার দায়িত্ব নিল তখন আমর এটাই সান্তনা ছিল আমি আমার দায়িত্ব শেষ করেছি। আমি মনে করি দেশ পরিচালনার কাজটি রাজনীতিবিদদের করা উচিত। তারা করবেন। এখন যে অবস্থা চলছে এই অবস্থায় কি করনীয় সেটাও তারাই ঠিক করবেন। যেটা দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কল্যানকর হবে সেইভাবেই চালাবেন।
আপনারাতো দুর্নীতি দমন করার যুদ্ধে নেমেছিলেন তাতো সফল হলো না? দুর্নীতি এখনও চলছে তবে ধরন বদলেছে, তিনি বলেন, দুর্নীতিটা বন্ধ করতেই হবে। এটা বন্ধ করা গেলে দেশের আরো অনেক উন্নতি হবে। জেনারেল মইন অনেকটাই নীরবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কিংবা ফ্লোরিডার তেমন কারো সঙ্গে মিশেন না। তিনি তার পরিবারের ও নিকট আতœীয়দের পরিমন্ডলেই থাকতে পছন্দ করেন। এই জন্য তাকে তেমন কোন অনুষ্ঠানে দেখা যায় না, এখানে অনেকেই আছেন যারা তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। তাকে নিয়ে অনেক কথাও বলেন।
জেনারেল মইন বলেন, আমি চাই না আমাকে নিয়ে কোন আলোচনা হোক। এই জন্য আমি তেমন কোথাও যাই না। কোন কথাও বলি না। এখানে অনেকেই আমাকে মিডিয়াতে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু বলি না। কারন একটা বললে আর একটা কথা ছড়াবে। এতে করে সমস্যা আরো বাড়বে। তাই সেই সব সমস্যা আমি এরিয়ে চলি। জেনারেল মইন এখনও ততটো সুস্থ নন। অনেক প্রসঙ্গে তার কাছ থেকে জানার আগ্রহ ছিল। কথা বলার ইচ্ছে ছিল। অসুস্থতার কারণে আজ সেটা সম্ভব হলো না। আবারও তার সঙ্গে যখন কথা হবে দেখা হবে তখন অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে।আমাদের সময়.কম