তিন বছরেও খোঁজ পাওয়া যায়নি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর। এরও অন্তত দেড় বছর আগে গুমের শিকার হন বিএনপির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম। গেল বছরের ২৭ নভেম্বর লাকসামের সাবেক এমপি, উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ নিখোঁজ হন। দীর্ঘ ছয় মাসেও তাদের হদিস মেলেনি। এভাবে বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ১৯ দলীয় জোটের অন্তত ৬৫ জন নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে দল ও সংশ্লিষ্ট পরিবারের পক্ষ থেকে। গুম হওয়া নেতাদের স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার দফতরে দফতরে ধরনা দিয়েও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। নিখোঁজ নেতারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন_ র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কেউ তা বলতে পারেন না। এ নিয়ে নিখোঁজদের পরিবার-পরিজনসহ বিএনপি নেতা-কর্মীরাও চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন, সবার মাঝে বিরাজ করছে আতঙ্ক_ কখন কে কাকে তুলে নিয়ে যায়। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর ধারাবাহিক খুনোখুনি, গুম-অপহরণের ঘটনায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের এ আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, ঘরে-বাইরে কেউই আর নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। এ অবস্থায় গুম, খুন ও অপহরণের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ১০ দফা নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বিএনপির সব সাংগঠনিক ইউনিটে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও কেন্দ্রীয় নেতাদের সতর্কভাবে চলাফেরা করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ নির্দেশনা পেয়ে সতর্কভাবে চলাফেরা করছেন নেতারা। বিশেষ করে রাতে সামাজিক অনুষ্ঠানে পর্যন্ত একা যাতায়াত করছেন না। বন্ধ করে দিয়েছেন একা একা চলাফেরা। দিনেও কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে-কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন দল ও অঙ্গ সংগঠনের মধ্যম সারির তরুণ নেতারা। রাজধানীতে রাতে টিভি টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেও অনেক ক্ষেত্রে তারা অপারগতা প্রকাশ করছেন। এমনকি নিজের বাসায় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে রাত কাটাতেও ভরসা পাচ্ছেন না অনেকেই। কখন কোন বাহিনীর পরিচয়ে এসে কারা তুলে নিয়ে যায়_ এই আশঙ্কায় বিনিদ্র রজনী কাটছে আতঙ্কিত নেতাদের। বিশেষ করে তৃণমূলের সাবেক জনপ্রতিনিধি এবং আগামীতে জনপ্রতিনিধি হতে আগ্রহীরা রয়েছেন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে। বিএনপির দাবি, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ মাসেই ১৯ দলীয় জোটের অন্তত ৩১০ জন নেতা-কর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে খুন হয়েছেন_ ২৭৮ জন, গুম হয়েছেন ৩২ জন। এ গুম-খুনের তালিকাও প্রকাশ করেছে বিএনপি। তবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে গুম, খুন, অপহরণের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতারা। নতুন কোনো তালিকা প্রকাশ না করা হলেও সংশ্লিষ্ট নেতারা জানিয়েছেন, গত তিন মাসেই গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী। এর মধ্যে গুমের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩৩ জন। শীঘ্রই এ সংক্রান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলেও ১৯ দলীয় জোট সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, প্রতিনিয়তই গুম, খুন, অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এর শিকার হচ্ছেন বিএনপি জোটের নেতা-কর্মীরা। এসব ঘটনা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে। হত্যা-গুমকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেন বিএনপির মুখপাত্র। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, গুম, খুন বা অপহরণে আগের সরকারগুলো তৎপর থাকলেও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাদের উদ্বিগ্ন কিংবা চিন্তিত হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে গুম-খুনের মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সন্ত্রাসী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। খুবই খারাপ লক্ষণ। এ জন্য সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় গুমের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ২৫ জুন। ওই দিন রাতে রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নং ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমকে সাদা পোশাকের কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে আটক করে নিয়ে যায়। চার বছরেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এরপর ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর গাজীপুর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে একদল সাদা পোশাকধারী বিএনপি নেতা ও চট্টগ্রামের করলডেঙ্গার ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাচাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আর তার সন্ধান মেলেনি। ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর বরিশালের উজিরপুরের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খান ঢাকার মালিবাগ থেকে নিখোঁজ হন। ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আল-মোকাদ্দেস ও ওয়ালিউল্লাহ নিখোঁজ হন। ওই দিন ঢাকায় ব্যক্তিগত কাজ শেষে হানিফ এন্টারপ্রাইজের গাড়িতে করে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মাঝামাঝি সময়ে সাভারের নবীনগর পেঁৗছলে র্যাব পরিচয়ে গাড়িটি থামিয়ে তাদের তুলে নেওয়া হয়। ২০১২ সালের ১ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন সিলেট জেলা ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ দিনার। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুমের শিকার হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. আনসার আলী। ওই দিন রাত সোয়া ১২টার দিকে নিজের বনানীর বাসায় ফেরার পথে বনানীর ২ নম্বর সড়ক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাদের কোনো হদিস মেলেনি। ২০১৩ সালের ২৩ জুন নিখোঁজ হন খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি বিবিএর দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র আল-আশিক নির্মাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা শেষে রায়েরমহল থেকে নিখোঁজ হন তিনি। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ নিখোঁজ হন। ওই দিন তারা দলের আহত নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিতে অ্যাম্বুলেন্সে কুমিল্লা হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। পথে আলীশ্বর এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি থামায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। তারা আর ফিরে আসেননি। ২৮ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গুম হন ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের পাঁচ কর্মী। তারা হলেন_ সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খান, একই ওয়ার্ডের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দল সম্পাদক মিঠু। ২ ডিসেম্বর বংশাল থানা ছাত্রদলের সহসভাপতি মো. সোহেল, বিএনপি নেতা মো. হোসেন চঞ্চল, বংশাল ৭১ নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. পারভেজ, একই ওয়ার্ডের ছাত্রদল নেতা মো. জহির শাহবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনকে বাড্ডা এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। একই দিনে ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা তানভীর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা আসাদুজ্জামান রানা, মাজহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন আমেরিকান দূতাবাস এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ৪ ডিসেম্বর রাত আড়াইটার দিকে তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা কাউসার ও এস এম আদনান চৌধুরীকে শাহীনবাগের বাসা থেকে র্যাব পরিচয়ে কয়েকজন লোক তুলে নিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র জিয়াউর রহমান শাহীন। ৬ ডিসেম্বর তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-সম্পাদক মো. তরিকুল ইসলাম রাজধানীর দক্ষিণ খান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন ও ছাত্রদল নেতা ফরহাদ হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার নয়াকান্দি গ্রামের সালাম চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে সাদা পোশাকধারী পাঁচজন লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক করে নিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টু পল্লবী এলাকা থেকে গুম হন। ওই দিন রাত ১টার দিকে তার বাসা (বাড়ি নং-৫ (তৃতীয় তলা), রোড নং-৯, সেকশন-বি, মিরপুর-১২) থেকে সাদা পোশাকের ৬-৭ জন লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে পিন্টুকে সিলভার কালারের মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যায়। ১৯ ডিসেম্বর ৫৭ নং ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক সোহেল ও রানা হাইকোর্ট এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। এ ছাড়া ডিসেম্বরে রাজধানী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় আলোর পরশ পত্রিকার সম্পাদক আলতাফ হোসেন। এদিকে অপহরণ, গুম ও হত্যার ঘটনা এড়াতে দলীয় নেতা-কর্মীদের ১০ দফা পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। দফাগুলো হলো_ প্রত্যেকের আওতাধীন এলাকায় লিফলেট, পোস্টার, সভাসহ বিভিন্নভাবে অপহরণ, গুম সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা, চলাফেরায় সতর্ক থাকা, একা চলাচল, নির্জন ও অনিরাপদ স্থান এড়িয়ে চলা, কর্মীরা নেতাদের, নেতারা কর্মীদের এবং সবাই মিলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখা। যতদূর সম্ভব পারস্পরিক যোগাযোগ বজায় রাখা, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থানীয় কর্মকর্তাদের ফোন নাম্বার সংগ্রহে রাখা এবং যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত জানানো, কেন্দ্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, কোথাও অপহরণের সংবাদ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে সবাই মিলে উপস্থিত হওয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কাউকে আটক করার চেষ্টা করা হলে তাদের পরিচয় এবং কোথায় নেওয়া হচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া, আটক ব্যক্তিকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে দলবল গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভুয়া পরিচয় দিলে তাদের প্রতিরোধ করা এবং পুলিশে সোপর্দ করা এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানো।