রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতায় ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ অর্থনীতির নিয়মিত কর্মকাণ্ডগুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে৷ তাই চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়টি মাস বা ২০১৩ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালটি ভালো যায়নি৷ চলেছে অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে৷
অবশ্য পরের মাসগুলোয় ধীরে ধীরে অনেক কিছু স্বাভাবিক ও স্থির হয়েছে৷ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে৷ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আছে, এর রিজার্ভও সুসংহত অবস্থায় রয়েছে৷ আমদানি বেড়েছে৷ প্রথম ১০ মাসে আমদানিতে ১১ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে পাঁচ গুণ৷
আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর৷ আর এই বছরটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন একটি স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য যেন ভালোভাবে চলে, সরকারের জন্য সেটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)৷
এ জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, যেন তারা বিনিয়োগ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনে৷ একই সঙ্গে জোর দিতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের (আইএমইডি) মতো রাষ্ট্রের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কারকাজে, যেন সেগুলো ব্যবসা-সহায়ক হয়৷
তবে এখানেই থেমে যাওয়ার উপায় নেই৷ বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারে আরও সম্পৃক্ত হতে হবে এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের দিকে সমানভাবে মনোযোগ দিতে হবে৷ যেমন, শিগগিরই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করা হবে৷ এ জন্য অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার সতর্কতার সঙ্গে নজরদারিতে রাখতে হবে৷ যেন মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ না পড়ে৷
অর্থাৎ, সিপিডি মনে করছে, আগামী অর্থবছর সরকারের সামনে এই চারটি বড় কাজ এসে দাঁড়িয়েছে৷ রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের অর্থনীতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে এসব কথা বলেছে সিপিডি৷ এতে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন৷
সিপিডি জনপ্রশাসন আইন সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও অর্থ ব্যয়ের স্বাধীনতা দিয়ে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা এবং বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে৷
রাজস্ব: সিপিডি মনে করে, চলতি অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় রাজস্ব আদায় কমেছে৷ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আয়ে মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ এ বছর ২৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা আছে৷ সংশোধিত সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা (এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা) অর্জন করতে হলে আগামী দুই মাসে আগের বছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে৷
সিপিডির পর্যালোচনা হলো—ধাতব ট্যাংক, ড্রাম, ক্যান, ক্রেন, উড়োজাহাজ ইত্যাদির আমদানি বেড়েছে৷ এগুলোতে শূন্য বা সামান্য শুল্ক আরোপ করা আছে৷ কম শুল্ক হওয়ায় এখানে টাকা পাচারের সম্ভাবনা থাকে৷ টাকা পাচার রোধে এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইজিং সেলকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি৷ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে মূল্য দেখানো হয়, তা সব সময় সঠিক হয় না৷ কেননা, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি মূল্য দেখিয়ে কিছু অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দেয়৷ এটা রোধ করতে এই সেল গঠন করা হয়েছে৷
উন্নয়ন ব্যয় ও বিদেশি সহায়তা: সরকারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি৷ সংস্থাটি বলছে, উন্নয়নের জন্য বড় বিনিয়োগ সাশ্রয়ীভাবে করতে না পারলে ব্যয় বাড়বে৷ এতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে৷
আবার বিদেশি সহায়তায় অনুদানের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে৷ এতে বৈদেশিক সহায়তা পরিষেবায় চাপ বাড়ছে৷
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মাত্র ৭৯৯ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে রয়েছে৷ এটি মোট বিদেশি সহায়তার ১২ শতাংশ৷ আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) দশমিক ৭ শতাংশ৷
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা সরকারকে অর্জন করতে হবে৷ আগামী ১০ বছরে অবকাঠামো বিনিয়োগের জন্য ৮০ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার (৮ থেকে ১০ হাজার কোটি ডলার) লাগবে৷ প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার কোটি ডলার অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন৷ এ অবস্থায় পাইপলাইনে এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা পড়ে থাকা দুঃখজনক৷ উল্লেখ্য, এই অঙ্ক বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের খুব কাছাকাছি৷
রেমিট্যান্স: এ বছর প্রবাসী-আয় আসার পরিমাণও বেশ কমেছে৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে৷ একই সময়কালে রেমিট্যান্স বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের এমন ছয়টি দেশ থেকে এবার এই আয় কমেছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ৷
কারণ হিসেবে সিপিডি বলছে, ২০১২ সালে যেখানে প্রতি মাসে দেশ থেকে গড়ে ৫৭ হাজার মানুষ বিদেশে কাজের খোঁজে যেত, সেখানে এ বছর তা নেমে এসেছে ৩৩ হাজারে৷
বিদ্যুৎ খাত: সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করে সিপিডি বলেছে, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও প্রকৃত উৎপাদন এর চেয়ে তিন হাজার মেগাওয়াট কম৷ ২০০৯ সালে সক্ষমতা-উৎপাদনের এই ঘাটতি ছিল এক হাজার মেগাওয়াট৷
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ অবশ্যই উৎপাদন করতে হবে৷ তবে সেটা যদি সাশ্রয়ী না হয় তাহলে তা উৎপাদনশীল খাতগুলোকে আক্রান্ত করে৷ এটা পণ্যমূল্যকে প্রভাবিত করে, দাম বেড়ে যায়৷ চূড়ান্তভাবে এর প্রভাব গিয়ে পড়ে ভোক্তার ওপর৷ তিনি আরও বলেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপন ব্যয় আগেই উঠে গেছে৷ তাদের এখন কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা৷ কিন্তু তারা আগের মতোই বেশি দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে৷ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আবার বাড়ানো হয়েছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত৷ ফলে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ আরও বিলম্বিত হলো৷
রপ্তানি: রানা প্লাজার ঘটনার পরও পোশাক খাতের রপ্তানি ভালো হয়েছে৷ এ খাতের জন্য সরকার কর সুবিধাও দিয়েছে৷ এই প্রণোদনা ঠিক আছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার রক্ষা হচ্ছে কি না, শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন কি না, সেদিকে নজর দিতে হবে৷ বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঠিকা কাজ করার (সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানা) মাধ্যমে দেশের পোশাক খাত এত দূর এসেছে৷ তাই তাদের যেন কিছু সহায়তা দিয়ে মূলধারায় আনা যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে৷
চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন খাতের রপ্তানি যেখানে কমেছে, সেখানে পোশাক খাতের বাইরে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে চামড়া ও পাদুকাশিল্প৷ এখন পর্যন্ত চামড়া খাতে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং পাদুকা খাতে ৩০ শতাংশের বেশি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চামড়া ও পাদুকাশিল্প খাত দেশের ‘দ্বিতীয় পোশাক খাত’ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে৷ এসব পণ্যের চাহিদা দেশে ভালো, বিশ্ববাজার বড়, দেশে মূল্য সংযোজনও বেশি হয়৷ এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে৷