কালোটাকা নিয়ে প্রশ্ন করায় স্পষ্টতই বিব্রত হলেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটের আগে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না। কিন্তু এ নিয়ে বাজেটে একটি কথাও বলেননি তিনি। অথচ চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটেই কালোটাকা সাদার সুযোগ দিয়ে রেখেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) একে বলেছে কালোটাকার প্রতি অর্থমন্ত্রীর নীরব সমর্থন।
বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ কালোটাকা নিয়েই প্রশ্ন করা হলো অর্থমন্ত্রীকে। উত্তরে তিনি বললেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আর দেওয়া হচ্ছে না।
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর এ উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না সাংবাদিকেরা। কারণ, আয়কর আইনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ চলতি বাজেটেই রাখা আছে। বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য বারবার প্রশ্ন করতে থাকেন সাংবাদিকেরা। এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, বাজেট বক্তৃতায় কালোটাকা সাদা করার প্রসঙ্গটি আনতে তিনি আসলে ভুলে গিয়েছিলেন। এরপর অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘ধরে নিন, আজ থেকে এটি বাতিল হয়ে গেল।’
তাতেও বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় এ বিষয়ে কথা বলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আবাসন খাতে, ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ ও জরিমানা দিয়ে যেকোনো অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা যায়। এটি রাখা না-রাখা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পাসের আগেই বিষয়টির সুরাহা হয়ে যাবে।’ তিনি আরও জানান, পুঁজিবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে কালোটাকা নিয়ে সোচ্চার দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদেরা। তার পরও বাজেটে লুকিয়ে হলেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে সরকার। এ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী কালোটাকা সাদা করা বাদ দিয়ে দিলেন, আর এনবিআরের চেয়ারম্যান আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে বলে জানালেন। বিষয়টি গোলমেলে। আমার মনে হয়, পুরো বিষয়টি নিয়ে নৈতিক অবস্থানের দৃঢ়তা দেখাতে পারছেন না অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ একধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে আছেন।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত নীতি অনুযায়ী এবং জনগণের আস্থা অর্জনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকা সরকারের উচিত বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ সুযোগ শুধু অনৈতিক নয়, বৈষম্যমূলক এবং অসাংবিধানিকও।’
গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন। প্রথাগতভাবে বাজেট পেশের পরের দিনই সংবাদ সম্মেলন করেন অর্থমন্ত্রী। গতকাল সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা সংবাদ সম্মেলনে কালোটাকা নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। এর বাইরে সংবাদ সম্মেলনটি ছিল বৈচিত্র্যহীন ও একঘেয়ে। উপস্থিত মন্ত্রীরা দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন। আর কিছু ব্যতিক্রম বাদে সাংবাদিকদের প্রশ্নও ছিল গতানুগতিক ও গুরুত্বহীন। কেউ কেউ আবার অর্থমন্ত্রীর প্রশংসাতেই ব্যস্ত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় আরও ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব ফজলে কবির, এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন ও পরিকল্পনাসচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও এ থেকে কখনোই ভালো কোনো ফল পাওয়া যায়নি। একমাত্র ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কালোটাকা সাদা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত দেশে সব মিলিয়ে ১৩ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা সাদা হয়েছে, এর মধ্যে কেবল ২০০৭-০৮ সালেই হয়েছে নয় হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
কালোটাকা আশানুরূপ সাদা না হওয়ার তথ্য অর্থমন্ত্রীর কাছেও রয়েছে। সেই হতাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কালোটাকা কেউ সাদা করে না। গতবার তিনটি উৎস রেখেছিলাম। কর পাওয়া গেছে মাত্র ৩৪ কোটি টাকা।’ তিনটি খাত হচ্ছে আবাসন খাত, ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ ও জরিমানা দিয়ে যেকোনো সময় অপ্রদর্শিত আয় সাদা করা।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কালোটাকার উৎপাদন কীভাবে হয়, তার অন্য কারণ আছে। এ ব্যাপারে আগেই বলেছি, একটা সমীক্ষা করা হবে। এর আগে একটা সমীক্ষা করাও হয়েছিল।’ দেশের অর্থনীতিতে ৪২ থেকে ৮২ শতাংশ পর্যন্ত কালোটাকা রয়েছে বলে ওই সমীক্ষায় উঠে এসেছিল বলে তথ্য দেন অর্থমন্ত্রী।
আর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, কালোটাকা উৎপাদনের বড় উৎস হচ্ছে জমি নিবন্ধন। অর্থাৎ জমির নিবন্ধনমূল্যের সঙ্গে প্রকৃত মূল্যের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি কীভাবে দূর করা যায়, ভেবে দেখা হচ্ছে।
এবারের বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বললেন সবাই। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এ সমালোচনাকে সহজেই মেনে নেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সবাই বলছেন, বাজেট উচ্চাভিলাষী। হ্যাঁ, প্রথমবার (২০০৯-১০) থেকেই উচ্চাভিলাষী বাজেট দিচ্ছি এবং প্রথম থেকেই আমাদের অর্জন অসাধারণ। ব্যয় করার সামর্থ্য আছে। এটাই আমাদের সরকারের চরিত্র। এটি বজায় রাখা হবে।’ তিনি বলেন, উচ্চাভিলাষের কারণেই পাঁচ বছর পর বাজেটের আকার দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে।
জিডিপি: আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে